নেবুলা-শব্দটি শুনলেই আমাদের বিভিন্নজনের মাথায় বিভিন্ন চিন্তা আসে৷ যেমন, যারা Marvel এর ফ্যান, তারা চিন্তা করে গ্যামোরার বোন নেবুলার কথা। আবার জাফর ইকবালের ভক্তদের মাথায় আসে “আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা’র কথা। আবার যারা অতীব জ্ঞানী তারা বলবে নেবুলা তো একটা ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ মেঘ। এর উৎপত্তি হচ্ছে হ্যানত্যান হ্যানত্যান হ্যানত্যান। যাই হোক যারা এই উপরের শ্রেণির কোনোটাতেই পড়েননাই তাদেরকে আমার সাদর অভিনন্দন। কারণ আজকে আমি এমন এক বস্তু নিয়ে কথা বলব,যার নাম নেবুলা ঠিকই, কিন্তু সেটি কোনো সাহিত্য থেকে নয়, বরং বাস্তব জগৎ থেকে নেওয়া হয়েছে। সহজ কথায় বললে নেবুলা মহাকাশে বিদ্যমান কতগুলো আয়োনাইজড গ্যাসের সমষ্টি। (আমাদের পরিচিত মেঘের মতোই,শুধু এখানে গ্যাসগুলো ভিন্ন) এটি এমন এক বস্তু, যার নাম পিপঁড়ে (Ant Nebula) থেকে শুরু করে ঘোড়ার মাথা (Horse Head Nebula) কিংবা শিয়ালের পশম (Fox Fur Nebula) অথবা বিড়ালের চোখ (Cat’s Eye Nebula) এমনকি বুমেরাং (Boomerang Nebula)হতে পারে!!!!
নেবুলার জন্ম :
নেবুলার যেমন হরেক রকম নাম রয়েছে,তেমনি তার জন্মস্থল ও রয়েছে অনেক ধরনের। কোনো কোনো নেবুলা মহাকাশে থাকা হিলিয়াম,হাইড্রোজেন ,ধুলাবালি ও অন্যান্য আয়োনাইজড গ্যাস থেকে জন্ম নেয়, কেউ কেউ আবার সুপারনোভা থেকে। তারা বা নক্ষত্র থেকে যেমন জন্ম নিতে পারে নেবুলা ,তেমনি নেবুলা থেকেও অনেক সময় তারার উৎপত্তি ঘটতে পারে।
?প্রথমেই বলি সাধারণ নেবুলার কথা। মহাকাশে হয়তো হাইড্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাস রয়েছে, হঠাৎ তাদের ইচ্ছা হল তারা একসাথ হয়ে নেবুলা গঠন করবে। ওমনি ধুলাবালি (আমাদের পৃথিবীর মাটি নয় কিন্তু !,বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের অবশেষ) এসে দাবি জানালো, নেবুলায় থাকবে তারাও। অন্যান্য গ্যাসগুলোও আন্দোলন শুরু করলো। কী আর করা,সবাইকে নিয়ে যাত্রা শুরু হল একটি নতুন নেবুলার।
?সুপারনোভার বিস্ফোরণ থেকে অবশিষ্ট বস্তুকণা ,গ্যাসগুলো আয়োনাইজড হয়েও নেবুলা গঠন করে,যেগুলো সুপারনোভা নেবুলা নামে পরিচিত। ১০৫৪ সালে একটি সুপারনোভার বিস্ফোরণ ঘটে,যা থেকে পরে ক্র্যাব নেবুলা সৃষ্টি হয়। এখন এই নেবুলার কেন্দ্রে একটি নিউট্রন তারকা রয়েছে।
?অনেক সময় মহাকাশে বিদ্যমান কোনো নেবুলা জায়ান্ট মলিকুলার ক্লাউড (যা মহাকাশে অবস্থানরত গ্যাসের সবচেয়ে ঘন এবং সবচেয়ে ঠাণ্ডা অবস্থা) এর সাথে একত্রিত হয় এবং অধিক ঘনত্বের একটি গ্যাসীয় আকৃতির সৃষ্টি করে। এই আকৃতি পরে চাপের প্রভাবে তারায় রুপান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে ঘন আকৃতির মাঝে তারাটির জন্ম হয়(অর্থাৎ মাঝের ঘন গ্যাসগুলো তারায় রুপান্তরিত হবে ) আর এই তারা থেকে বিকিরিত অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে চারপাশে থাকা ঘন গ্যাসগুলো আয়োনাইজড হয়। (যখন Giant Molecular Cloud এর সাথে নেবুলা যুক্ত হবে তখনই এর গ্যাসগুলোর ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে,এছাড়া কোনো নেবুলায় বিদ্যমান গ্যাসের ঘনত্ব খুবই কম)। আর এই আয়োনাইজড, ঘন গ্যাসগুলোর কারণেই আমরা খালি চোখে নেবুলা দেখতে পাই। ওরিয়ন নেবুলা ,ওমেগা নেবুলা এরকম নেবুলা যাদের থেকে তারার জন্ম ঘটেছে। আবার অনেকের মতে আমাদের সৌরজগতও নেবুলা থেকে সৃষ্ট।
ফ্যাক্টঃ তারা উৎপাদনকারী নেবুলাগুলো বিভিন্ন কারণে (যেমন সুপারনোভা বিস্ফোরণ,অতিবেগুনী রশ্মি ইত্যাদি) তারার জন্ম হওয়ার কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। কিছুটা মা মাকড়সার মত।
?প্ল্যানেটারী নেবুলা কিন্তু আসলে গ্রহ থেকে সৃষ্টি হয় না, এরা কম ভরের নক্ষত্র থেকে সৃষ্ট হয়। (এখানে কম ভর বলতে ১ কেজি ২ কেজি নিয়ে কথা বলছি না, এখানে কম ভর মানে ৮-১০ solar mass এর মধ্যে যেসব নক্ষত্রের ভর তাদের কথা বলা হচ্ছে.আর ১ solar mass=2*10^30 kg।তাহলে চিন্তা করুন তো, পৃথিবীতে ২০০ কেজি বলে লোকে আপনাকে মোটা বলে, আর এত বিশাল ভর থাকা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে তারাগুলোর নাকি ভর কম!) তো, এই তারারগুলোর জীবদ্দশায় তারা লোহিত দানবে পরিণত হয় এবং যখন আস্তে আস্তে তাদের বাইরের স্তরটুকুও ধ্বংস হয়ে যায় তখন সেই তারাটির তামাত্রা বৃদ্ধি পায় আর তা উচ্চমাত্রার অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ শুরু করে।এতে আশেপাশের গ্যাসগুলো এবং গ্রহ-উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ আয়োনাইজড হয়ে একটি নেবুলা সৃষ্টি করে।তারাটি শেষে শ্বেত বামন হয়ে নেবুলার কেন্দ্রে অবস্থান করে। Oyster নেবুলা এমন একটি নেবুলা। এটি Camelopardalis কনস্টেলেশন এ অবস্থিত। Planetary নেবুলাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান গ্যাস কিন্তু তারা উৎপাদনকারী নেবুলার (Star Formation Region) থেকেও বেশি ঘন থাকে।এখন কথা হচ্ছে,তারা থেকে সৃষ্ট নেবুলার নাম ‘Planetary’দেওয়া হয়েছে কেন?কারণ প্রথম যারা এই ধরণের নেবুলা আবষ্কার করেছিলেন,তারা এই ধরণের নেবুলাকে গ্রহ ভেবে ভুল করেছিলেন।
?Protoplanetary নেবুলা বলে একটা কথা আছে, যা Planetary নেবুলার পূর্ব দশা। কোনো নক্ষত্রের Stellar Evolution পর্যায়ে এবং তার পরের সময়ে তারাটি দ্রুত তার ভর হারাতে থাকে। এসময়ে তারাটির চারপাশে হাইড্রোজেন এর একটি স্তর সৃষ্টি হয়।এর পরে তারাটির প্রভাবে এই স্তর শক্তি লাভ করে আর ইনফ্যারেড রশ্মি বিকিরণ শুরু করে। এই যে স্তরের শক্তি বিকিরণ ,এটাই এক ধরণের নেবুলা বা আরেক ধরণের নেবুলার পূর্বদশা ,যাকে Protoplanetary Nebula বা PPN বলা হয়। এরা Reflection নেবুলার অনুরূপ আলো বিকিরণ না করে অন্য নক্ষত্র থেকে আগত আলোকে প্রতিফলিত করে। Red Retrangle Nebula এই ধরণের একটি নেবুলা। PPN৩০,০০০ কেলভিন তাপমাত্রায় পৌঁছালে তা Planetary Nebula তে পরিণত হয়।
ফ্যাক্ট সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমাদের প্রিয় সূর্যও একদিন (প্রায় ৫বিলিয়ন বছর পর) একটি সফল নেবুলায় রুপান্তরিত হতে পারবে, আমরা এই আশা করি।
নেবুলা –আরো কথা :
?নেবুলা কয়েক আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পার।
?ডার্ক নেবুলা নামে আরেক ধরণের নেবুলা আছে, এদের খালি চোখে দেখা যায়। এরা নক্ষত্র হতে আগত কোনো আলোই প্রতিফলিত করে না বলে এদের নাম ডার্ক নেবুলা দেওয়া হয়েছে। Horsehead Nebula একটি ডার্ক নেবুলা যা ওরিয়ন কন্সটেলেশন এ অবস্থিত। এটি ৩.৫ আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত।
?সাধারণত দেখা যায়, আলো বিকিরণকারী নেবুলাগুলো লাল বা গোলাপী রং এর হয়। আবার প্রতিফলন নেবুলাগুলোর রং নীল হয়।
?আমাদের সবচেয়ে কাছের নেবুলা আমাদের থেকে ১৩৪৪±২০ আলোকবর্ষ দূরে। এটি ২৪ আলোকবর্ষ জুড়ে বিস্তৃত।বলুন তো এই নেবুলার নাম কী?
?১৯২০ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মিল্কি ওয়ে ছাড়া বাকি গ্যালাক্সিগুলোকে নেবুলা বলে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন!
?Gum নেবুলা বলে একটি নেবুলা আছে যার ভেতর আরেকটি নেবুলা অবস্থিত।দ্বিতীয় নেবুলাটির নাম Vela Nebula ।
?নেবুলা দেখতে স্থির,শান্তশিষ্ট মনে হলেও এরা গতিশীল। কোনো কোনো PN এর ত্বরণ ৩০কিলোমিটার /সেকেন্ড^২ পর্যন্ত হতে পারে।
?কোনো এক রহস্যময় কারণে দেখা যায়,কোথাও কোনো বিকিরণকারী নেবুলা থাকলে তার আশেপাশে আরেকটি রিফ্লেক্সশন নেবুলা থাকে।
?১৫০খ্রিস্টপূর্বে Claudius Ptolemaeus যাদের নেবুলা বলে তার বইয়ে আখ্যায়িত করেছিলেন তারা আসলে নক্ষত্র ছিল। প্রথম প্রকৃত নেবুলা observe করেন পারস্যের Abd al-Rahman al-Sufi।
?Eagle nebula হল অন্যতম বিখ্যাত একটি নেবুলা।এটি অনেকগুলো পিলার আকৃতির সমন্ব্যে গঠিত। পিলারের প্রত্যেক মাথায় তারার জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নেবুলাটি আমাদের থেকে ৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।এই নেবুলার শুধুমাত্র একটি নাম দিয়েই বিজ্ঞানীরা ক্ষান্ত হননি। এর নাম Star queen nebula বা The spire.
নেবুলা নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো একদিন সারাটা কেটে যাবে,তাও লেখা শেষ হবে না।তাই আমার প্রিয় কয়েকটা ফ্যাক্ট দিলাম।যদি আপনাদের পছন্দের আর কোনো পয়েন্ট থাকে তাহলে তা আমাকে জানাতে পারেন,আমি খুব খুশি হব। আচ্ছা তাহলে,আজকের মত টা টা বাই বাই।???
কৃতজ্ঞতা:
1) Wikipedia.org
2) Factslegend.org
3) 10interestingfacts.com
4) space-facts.com