শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব হতে আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে, আলোর বেগ একটি ধ্রুবক। পরবর্তিতে যা হিসেব করে পাওয়া যায় যে, আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার বা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল অতিক্রম করতে সক্ষম! তবে এখানে আমাদের বেশীর ভাগেরই কিছু বুঝার সমস্যা রয়েছে বলে কথা দিচ্ছি! কল্পনা করুন, আপনি আলোর দিকেই সেকেন্ডে এক লক্ষ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছেন। তবে আপনার কাছে আলোর বেগ কত মনে হবে? আপেক্ষিক বেগের চিন্তা মাথায় থাকলে আপনি সহজেই উত্তর দেবেন আলো আপনার সাপেক্ষে সেকেন্ডে দুই লক্ষ কিলোমিটার বেগে চলছে।

ঘন্টায় ৪০ কি.মি চলন্ত ট্রেনের উপর ঘন্টায় ১০ কি.মি বেগে চলন্ত লোকের বেগ ট্রেনের বাইরে স্থির অবস্থায় দাঁড়ানো কারো কাছে ঘন্টায় ৫০ কি.মি মনে হবে।
বুঝার ভুলটাও ঠিক এখানেই। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর বেগ ধ্রুব বলতে বুঝায়, আপনি আলোর দিকে সেকেন্ডে এক লক্ষ কিলোমিটার বেগে চললেও আপনার সাপেক্ষে আলো ঠিক তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগেই চলবে! এই মাথার ব্যায়ামটুকু মাথায় নিয়েই চলুন সামনে এগুনো যাক। আপনার বুঝার ভুল কিংবা যাই হোক না কেন, আলোর বেগই যে মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ তাতে কোন সন্দেহ নেই! তবে চলুন দেখে নেয়া যাক, আমরা কিভাবে এতটা নিশ্চিত হলাম এই বিষয়ে!
আলোর বেগ বলতে আমরা মূলত বুঝে থাকি ফোটনের বেগ। তাই বলা চলে মহাবিশ্বে ফোটনের বেগই সর্বোচ্চ। অবাক করার মত ব্যাপার হলো, এর জন্য মূলত ফোটনের জড় ভর হীনতাই দায়ী! চলুন একটু ব্যাখ্যা করা যাক। বিজ্ঞানীরা ধারণা করে থাকেন যে, মহাবিশ্বের সকল বস্তুর ভরের পিছনে দায়ী মূলত হিগস ফিল্ড বা ক্ষেত্র, যা মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুতেই পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তবে অবাক লাগতে পারে যে, একটি ক্ষেত্রের সাথে এই ভর কিংবা বেগের সম্পর্কই বা কি তাহলে! তবে চলুন একটি রুম কল্পনা করা যাক যেখানে একদল খ্যাতনামা পদার্থবিদ বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের সাথে আলোচনা করে যাচ্ছেন। এখন রুমে যদি কোন রঙিন পর্দার নায়ক এসে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে চায় তবে কেউ তার দিকে লক্ষ্য ও করবেন নাহ! ফলে সে সহজেই রুমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু রুমে যদি স্বয়ং আইনস্টাইন এসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে চান, তবে দৃশ্যটি কেমন দাঁড়াবে? তাকে ঘিরে ঝটলা ঘটার দরুণ তার অন্যপ্রান্তে যাওয়াটা তেমন সহজ হবে না। বেগ এবং ভরের মূল ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই!

ফোটন হিগস ফিল্ড দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় না। তবে ইলেকট্রন কিছুটা এবং কোয়ার্কসহ অন্যান্য ভরযুক্ত পদার্থ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
আশা করি ধরতে পেরেছেন! হ্যাঁ, এখানে পদার্থবিদদের ভীড়কে যদি হিগস ক্ষেত্র বলে কল্পনা করি তবে তাদের দ্বারা যে যত বেশী বাধা পাবে তার ভর তত বেশী হবে, এবং বেগ ও কম হবে। অন্যদিকে, যে বাধা কম পাবে তার ক্ষেত্রে ভর কম হবে এবং বেগ বেশী হবে! ফোটন মূলত হিগস ক্ষেত্র থেকে কোনো প্রকার বাধা পায় না। তাই ফোটনকে ভরশূণ্য ধরা হয়ে থাকে এবং তার বেগ ও মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ ধরা হয়ে থাকে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার কিংবা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল? উত্তরে আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব চলে আসে। পদার্থবিজ্ঞানে আলোর বেগ মূলত একটি মুখ্য ধ্রুবক। আর আলোর বেগের সাথে সময় এর সম্পর্ক ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য স্বয়ং আইনস্টাইন নিজেই একটি উপায় বলে দিয়ে গিয়েছিলেন!
আইনস্টাইন লক্ষ্য করলেন যে, আমরা যদি আমাদের জীবনকে একটি ফোটনের জীবনের সাথে তুলনা করি তবে চিন্তা করতে উদ্ভট হলেও ব্যাপারটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক! মুহূর্তের মধ্যেই যদি আপনি ফোটনে রূপান্তরিত হয়ে যান, তবে সময়ের কোনো মূল্যই থাকবে না আপনার কাছে! আপনার কাছে চার পাশের সব কিছুই মুহূর্তের মাঝে ঘটে যাবে। চিন্তা করুণ আপনি পৃথিবী থেকে চার বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোন নক্ষত্র থেকে উৎপন্ন হওয়া এক নবজাত ফোটন। পৃথিবীতে অবস্থিত আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি আমার চোখে এসে ধরা দিতে সময় নেবেন চার বিলিয়ন বছর। কিন্তু আপনার কাছে মনে হবে আপনি জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই আমার চোখে এসে ধরা দিয়েছেন! অর্থাৎ আপনার জন্ম মৃত্যু আপনার জন্য সম্পূর্ণভাবে তাৎক্ষণিক একটা ব্যাপার। এর পেছনের মূল কারণ মূলত, আপনি আলোর বেগের সাপেক্ষে যত দ্রুত চলবেন, সময় আপনার জন্য তত আস্তে চলবে এবং আপনি যখন আলোর বেগে চলবেন সময় তখন আপনার জন্য থেমে যাবে! অর্থাৎ সময় বলে আপনি কিছু অনুভব করতে পারবেন না। এটিও মূলত কোনো বস্তু আলোর চেয়ে বেশী বেগে না চলতে পারার পিছনে দায়ী। কেননা আলোর বেগে এসেই আপনার জন্য সময় থেমে যায়। তাই এটি অনেকটা এমন মনে হবে যে, থেমে থাকা গাড়িকেই আপনি আরো আস্তে চালাতে চাচ্ছেন। ব্যাপারটি অনেকটা অদ্ভুত মনে হলেও এতোটা অদ্ভুত মনে হবে না যদি আপনিও আইনস্টাইন এর মত স্থান এবং সময়কে একই বলে চিন্তা করতে পারেন।
উনিশ শতকের দিকে এসে আইনস্টাইন সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে, সময় আর স্থান মূলত একই জিনিস! সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে ব্যাপারটিই উদ্ভটই বটে। কেননা আপনি যদি ত্রিমাত্রিক স্থানাংক ব্যাবস্থার সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন তবে সহজেই বলতে পারেন স্থান বলতে আমরা বুঝি তিনটি মাত্রা দিয়ে নির্দিষ্ট করা একটি জায়গা। ফলে আমরা ত্রিমাত্রিক একটি জড় কাঠামোর সাপেক্ষে ওই তিনটি মান জানলে সহজেই একটি বস্তু কোথায় আছে বলে দিতে পারবো।

ত্রিমাত্রিক স্থানাংক ব্যাবস্থা। যাদেরকে বাস্তব জীবনে আমরা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা দিয়ে প্রকাশ করি।
কিন্তু আইনস্টাইন চিন্তা করলেন যে, এ তিনটি মান দিয়ে আসলে বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কেননা আমরা জানি যে, সময়ের সাথে সাথে বস্তুর অবস্থানের ও পরিবর্তন হয়। তাই স্থানের এ তিনটি মাত্রার সাথে নতুন করে সময়ের মাত্রা যুক্ত করতে হবে। মাত্রাগুলোর দুটো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা পরস্পরের সাথে লম্বভাবে অবস্থান করে এবং একে অপরের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন আপনি চাইলেই X অক্ষকে Y অক্ষ এবং Y অক্ষকে X অক্ষ ধরে কাজ চালাতে পারবেন। তাই বলা চলে অক্ষগুলো মূলত একই গোয়ালেরই গরু। যখন আপনি স্থানের তিন অক্ষের সাথে সময়ের অক্ষ যোগ করবেন সময়ও তখন স্থানের মতই কাজ করবে এবং উভয়ে মিলেই আপনাকে একটি বস্তুর সঠিক অবস্থান প্রদান করবে। তবে বুঝা গেল স্থান-কাল আসলে একই জিনিস, কিন্তু তা কি করে আমাদের সময় আস্তে চলার সমস্যার সমাধান করবে?
কোন একটি বস্তুকে যখন আমরা গড়ায়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারি তবে তা শুধুমাত্র সামনের দিকে যাবে। আবার যদি আমরা তাকে খাঁড়া উপরের দিকে ছুঁড়ে মারি তবে তা শুধুমাত্র উপরের দিকেই যাবে। এবার চিন্তা করুণ আমরা যদি এই বস্তুটিকে মাটির সাথে একটি কোণ করে ছুড়ে মারি, তবে কি হবে?!

বাঁকাভাবে ছুঁড়ে মারায় বস্তুটি একইসাথে সামনে (X-অক্ষের দিকে) এবং উপরে ও (Y-অক্ষের দিকে) উঠেছে।
হ্যাঁ, আপনি একই বলে বস্তুটিকে উপরের দিকে ছুঁড়ে মারলে তা যতটা উপরে উঠতো ততটা উপরে উঠবে না হয়তো। কিন্তু বস্তুটি কিছুটা উপরে উঠবে এবং সাথে সাথে সামনেও কিন্তু যাবে এবার! খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন যে, গড়ায়ে সামনের দিকে যাওয়া এবং খাঁড়া উপরের দিকে উঠার মাঝে কোণ কিন্তু নব্বই ডিগ্রী. তাই যেহেতু তারা পরস্পর লম্ব, আমরা তাদের দুটিকে দুটো মাত্রা হিসেবে কল্পনা করতে পারি। এবার উপরের দিকে সময়কে কল্পনা করি এবং সামনের দিকে কল্পনা করি স্থানকে। আপনি যখন শুধুমাত্র সময়ের দিকে স্থানান্তরিত হবেন তখন আপনি স্থানের দিকে মোটেও স্থানান্তরিত হবেন নাহ অর্থাৎ আপনি স্থির থাকবেন।

যখন সময়ের দিকে চলছেন তখন স্থানের দিকে আপনার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
এমনকি এই মুহূর্তে আপনি তাই করছেন। বসে বসে এই বিশাল আর্টিকেল পড়ছেন যার ফলে সময় যাচ্ছে কিন্তু আপনার অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে না। এবার আপনি যদি কিছুটা স্থানের দিকে ঝুঁকে অবস্থানের পরিবর্তন শুরু করেন তবে বলা যায় আপনি কিছুটা বেগ লাভ করবেন এবং সময় আর আগের মত যাবে না।

একইসাথে আপনি সময় এবং স্থানের দিকে যাচ্ছেন। তবে এখন আর আগের মতো সময়ের দিকেই পুরোপুরি যেতে পারছেন না বা কম যাচ্ছেন।
ঠিক যেমন কোণ করে কোনো বস্তু ছুঁড়ে মারলে তা খাঁড়া উপরের মতো সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে নি। তাই বলা চলে আপনি যতই বেগ বাড়ানো শুরু করবেন, সময়ও তত আস্তে আস্তে চলা শুরু করবে! এবং এই বেগ যখন সর্বোচ্চ হবে বা ফোটনের সমান হবে, তখন মূলত সময়ের দিকে কোনো প্রকার পরিবর্তন হবে নাহ। আপনি তখন শুধুমাত্র স্থানের মধ্য দিয়ে চলবেন। অর্থাৎ আলোর বেগে অবস্থানের পরিবর্তন করলে সময় আপনার জন্য থেমে যাবে!

শুধুমাত্র স্থানের দিকে চলছেন আপনি। এখানে সময়ের দিকে কোনো পরিবর্তন নেই। অর্থাৎ শুধুমাত্র স্থানের দিকে চললে সময় আপনার জন্য চলবে না।
তাত্ত্বিকভাবে তো আমাদের সব রাস্তাই মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেল। তবে চলুন এবার আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে একটু চিন্তা করি। দেখি তারা আমাদের কতটুকু পথ বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। ব্যাপারটা কিছুটা সহজই মনে হচ্ছে এখানে। কেননা আমরা যদি কিছুটাও ত্বরণ দিয়েও তা ধরে রাখার জন্য বিরতিহীনভাবে শক্তি দিয়ে যেতে পারি, তবে একসময় আমরা আলোর বেগকে অতিক্রম করে অনেক দূরে চলে যাওয়ার কথা! তবে কেন করছি না আমরা?! প্রথমত ভরযুক্ত কোনো বস্তুকে ভালো মানের ত্বরণ দিতে আপনার তেমন শক্তির প্রয়োজন হবে নাহ। কিন্তু অনেক দূরের কথা চিন্তা করলে সর্বোপরি আপনার অনেক বিশাল শক্তিরই জোগান দিতে হবে বটে। তবে সমস্যা সেখানে নয়। ধরে নিলাম আপনি সেই পরিমাণ শক্তির জোগান দিতেও সক্ষম হলেন। এখানেও মূলত আবার আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব চলে আসে। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব বলছে, আপনার বেগ যত বাড়বে তার সাথে আপনার ভরও বাড়বে এবং আপনার বেগ যখন আলোর বেগের সমান হবে তখন আপনার ভর হয়ে যাবে অসীম। তাই তাকে চালাতে আপনার শক্তিও লাগবে অসীম! আর এই অসীম ভরের কোনো বস্তুর বেগ আরো বাড়াতে চাইলে আপনাকে আসলে অসীমের চেয়েও বেশী শক্তি দিতে হবে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদেরও এখানে অসহায়ই বলা চলে।
সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে, আলোর বেগের চেয়ে বেশী বেগে কোন বস্তু চলা সম্ভব নয়। তবে আমরা আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলতে পারি। যদি আমরা আলোর বেগের ২০ শতাংশ বেগও পেতে পারি, তবে আমাদের নিকটবর্তী পৃথিবী সদৃশ গ্রহ প্রক্সিমা-বি তে যেতে আমরা সময় নেব মাত্র বিশ বছর! আর মানব সভ্যতাকে আরেকটি গ্রহে নিয়ে হলেও টিকিয়ে রাখাই আমাদের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার সবচেয়ে বড় সফলতা হবে। আর হেরে যাওয়ার মতো প্রজাতি নই আমরা, জয় একদিন আসবেই। তাই জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করুন এবং জ্যোতির্বিদ্যার সাথেই থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
১ঃ https://zidbits.com/2011/05/why-cant-anything-go-faster-than-the-speed-of-light/
২ঃ https://www.youtube.com/watch?v=joTKd5j3mzk
৩ঃ https://cosmosmagazine.com/physics/why-nothing-can-go-faster-than-the-speed-of-light
৪ঃ http://www.bbc.com/earth/story/20160429-the-real-reasons-nothing-can-ever-go-faster-than-light