ওমোয়ামোয়া (Oumuamua) হল একটি গ্রহাণু, যা অল্প কিছুদিন আগেই আমাদের সৌরজগতে অতিথি হয়ে এসেছিল। অতিথি বলা হচ্ছে এই কারণেই যে, এই গ্রহাণুর সৃষ্টি আমাদের সৌরজগতে নয়। ওমোয়ামোয়াই হল বিজ্ঞানীদের সনাক্তকৃত প্রথম আন্ত:নাক্ষত্রিক বস্তু। জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট উয়েরিক অত্যন্ত দীর্ঘ অধিবৃত্তিক আবর্তন পথ (Highly Eccentric Hyperbolic Trajectory) সম্পন্ন এই গ্রহাণুটি দেখতে পান গত অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখ। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত PAN-STARRS টেলিস্কোপের সাহায্যে এই গ্রহাণুটি যখন প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়, তখন পৃথিবী থেকে এটির দূরত্ব ছিল মাত্র ০.২ এস্ট্রোনমিকাল ইউনিট (৩০ মিলিয়ন কি.মি., ১৯ মিলিয়ন মাইল)। বস্তুটিকে প্রথমে একটি ধুমকেতু হিসেবে ধারণা করা হলেও, এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পরই বিজ্ঞানীরা এটি একটি গ্রহাণু বলে নিশ্চিত হন।
ওমোয়ামোয়া একটি হাওয়াইয়ান শব্দ, যার অর্থ স্কাউট বা অনুসন্ধানকারী। সুদূর অতীতে অজানা উৎস থেকে আমাদের সৌরজগতের পানে রওনা দেবার কারণেই এ নামকরণ। গ্রহাণুটির ইন্টারন্যাশনাল এস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়ন প্রদত্ত নাম হল ‘1I/2017 U1’। এখানে 1 দ্বারা প্রথম এবং ‘I’ দ্বারা আন্ত:নাক্ষত্রিক বস্তু বোঝানো হয়েছে।
ওমোয়ামোয়া দেখতে অনেকটা ‘চুরুট (Cigar)’-এর মত, এবং আমাদের সৌরজগতের কুইপার বেল্ট বস্তুগুলোর মতই অনেকটা লোহিত বর্ণের। এর লম্বায় প্রায় ৬০০ ফুট (১৮০ মিটার) এবং পাশে ১০০ x ১০০ ফুট (৩০ x ৩০ মিটার)।
প্রায় ৩৪ দিন পর্যবেক্ষণের পর সূর্যের সাপেক্ষে গ্রহাণুটির অর্বিটাল এক্সেন্ট্রিসিটি হিসেব করা হয় ১.২; যা কিনা এর অত্যন্ত দীর্ঘ কক্ষপথের প্রমাণ দেয় (পক্ষান্তরে, পৃথিবীর অর্বিটাল এক্সেন্ট্রিসিটি হল ০.০১৬৭)।

ওমোয়ামোয়ার অর্বিটাল এক্সেন্ট্রিসিটি, S দ্বারা সূর্যকে বোঝানো হয়েছে
এছাড়া এর কক্ষপথ অধিবৃত্তিক এবং এটি আমাদের সৌরজগতে উপর দিক থেকে প্রবেশ করে।

গত ২৫শে অক্টোবর সৌরজগতে গ্রহাণুটির অবস্থান
(চিত্র- গত ২৫শে অক্টোবর সৌরজগতে গ্রহাণুটির অবস্থান)।
ওমোয়ামোয়ার দীর্ঘ অধিবৃত্তিক আবর্তনপথ প্রমাণ করে যে এটি আমাদের সৌরজগতের সদস্য নয়।
ধারণা করা হচ্ছে গ্রহাণুটি লিরা (Lyra) নক্ষত্রপুঞ্জের ভেগা (Vega) নামক নক্ষত্রের দিক থেকে এসেছে। তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, গ্রহাণুটি ক্যারিনা-কলাম্বিয়া নক্ষত্রগোষ্ঠীর কোন নক্ষত্র-ব্যবস্থা থেকে কোন কারণে ছিটকে বেরিয়ে গেছে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর আগে। ক্যারিনা-কলাম্বিয়া নক্ষত্রগোষ্ঠী বর্তমানে লিরা নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থানের চেয়ে অনেক দূরে রয়েছে।
গ্রহাণুটি প্রতি সেকেন্ডে ২৬.৩৩ কি.মি. গতিতে মহাশূণ্যে ভ্রমণ করে চলেছে। আর নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণন কাল হল ৮ ঘন্টা ৬ মিনিট। সূর্যের মধ্যাকর্ষণের ফলে পেরিহিলিয়নের সময় (সূর্যের সবচে নিকটাবস্থায়) গ্রহাণুটির গতি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭.৭১ কি.মি./সেকেন্ড যা সেই কক্ষপথ বিবেচনায় সূর্যের মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি। একারণেই গ্রহাণুটি সূর্যের মধ্যাকর্ষণের মধ্যে বাঁধা পরেনি।
ওমোয়ামোয়ার ট্রাজেক্টরি বা আবর্তন পথ পর্যবেক্ষণ করা হয় হাওয়াই-এর PAN-STARRS1 টেলিস্কোপ এবং কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ (CFHT)-এর সাহায্যে। আর গঠন ও আকার পর্যবেক্ষণ করা হয় চিলির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (VLT) ও জেমিনি সাউথ টেলিস্কোপ, হাওয়াই-এর Keck-2 টেলিস্কোপ এবং স্পেনের উইলিয়াম হার্শেল টেলিস্কোপের সাহায্যে।

২৮ অক্টোবর উইলিয়াম হার্শেল টেলিস্কোপে তোলা ছবিটিতে মাঝখানের বিন্দুটি হল ‘ওমোয়ামোয়া’। আর পেছনের তারাগুলোকে ছোট ছোট রেখার মত মনে হচ্ছে, কারণ টেলিস্কোপটি দ্রুতগামী গ্রহাণুটিকে অনুসরণ করছে
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্যারেন জে. মিখ, রবার্ট উয়েরিক এবং তাদের সহকর্মীদের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ২০ নভেম্বর ‘নেচার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
ওমোয়ামোয়া গ্রহাণুটি অক্টোবরের শেষ নাগাদই খুবই ক্ষীণ হয়ে যায় এবং তখন তার আপাত দ্যুতি (Apparent Magnitude) মাত্রা ছিল ~২৩।

২০২০ সাল নাগাদ ওমোয়ামোয়ার আপাত দ্যুতি ৩৪তম মাত্রায় নেমে যাবে
গ্রহাণুটি ২০১৮ সালের মে মাসে বৃহস্পতির, ২০১৯ এর জানুয়ারিতে শনির এবং ২০২২ সাল নাগাদ নেপচুনের কক্ষপথ অতিক্রম করবে। সৌরজগতের সীমানা ওর্ট ক্লাউড পার হতে এর প্রায় ২০,০০০ বছর লেগে যাবে।
ওমোয়ামোয়া যে গতিতে ছুটছে, তাতে বর্তমান সময়ের কোন স্পেসক্রাফ্টের পক্ষে তাকে ধরে ফেলা অসম্ভব। তবে Initiative for Interstellar Studies (i4is) আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সূর্য ও বৃহস্পতির মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওমোয়ামোয়াকে অনুসরণের জন্য স্পেসক্রাফ্টের পাঠানোর প্রস্তাব করেছে। তাছাড়া ‘ব্রেকথ্রু স্টারশট’ টেকনোলজি (লেজারের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র স্পেসক্রাফ্ট মহাকাশে নিক্ষেপ) কাজে লাগানো যায় কিনা সে ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা চলছে। যদি তদন্তকারী মহাকাশযানের গতি খুব বেশি হয়, তাহলে তা গ্রহাণুটির কক্ষপথে ঢুকতে বা গ্রহাণুটির উপর অবতরণ না করে তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেসব দিক বিবেচনা করলে, বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই একটি অনুসন্ধানী মিশন শুরু করে দেয়া যেতে পারে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতি বছর এরকম একাধিক আন্ত:নাক্ষত্রিক বস্তু পৃথিবীর পাশ দিয়ে চলে যায়। সুতরাং, ওমোয়ামোয়া হারিয়ে গেলেও আমাদের আশাহত হবার কোন কারণ নেই, ভবিষ্যতে আমরা অবশ্যই এরকম আরও অচেনা অতিথিকে জানার আশা রাখতেই পারি।
সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/ʻOumuamua
-ইফতেখার আহমেদ
সৌখিন জ্যোতির্বিদ,
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা (সিনিয়র অফিসার),
Email: iftu761@gmail.com