
আহমাদ আব্দুল্লাহ রিফাত
ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। হঠাৎ কিম্ভূতকিমাকার চেহারার এক এলিয়েনের সাথে আপনার দেখা। কিংবা মানুষের মতই কারও সাথে দেখা হলো, কিন্তু তার আচরণ বা চিন্তাভাবনা কোনটাই মানুষের মত না!
দুর্ভাগ্যবশত মানুষ এমন অভিজ্ঞতা শুধু সায়েন্স ফিকশন মুভিতেই পেয়েছে, বাস্তবে এমন এলিয়েনের দেখা কেউ পায় নি। কিন্তু তাই বলে এলিয়েন নিয়ে চিন্তাভাবনায় মানুষ ক্ষ্যান্ত দেয়নি কখনোই, বরং দিন যত এগিয়েছে মানুষ এলিয়েনদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে আরও। একটা সময় কল্পনা থেকে রসদ নিয়ে ছবি আঁকতো মানুষ, এখন অবজারভেটরিতে রীতিমত যজ্ঞ চালিয়ে চলছে এলিয়েন খোঁজার কাজ!
মহাবিশ্বে প্রায় – সংখ্যক নক্ষত্র আছে। সূর্য তার মধ্যে অতি সাধারণ একটি নক্ষত্র। সূর্যের মতই নক্ষত্র আছে কম করে হলেও ৫০০ বিলিয়ন! প্রতিটা নক্ষত্রেরই নিজস্ব গ্রহব্যবস্থা আছে। এত গ্রহের মধ্যে কেবল আমাদের গ্রহেই প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, এটা মেনে নেয়াটা আসলেই কষ্টকর। কিন্তু তারা যদি থেকেই থাকে, তাহলে তারা কোথায়? এই প্রশ্নটিই জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্থান করে আছে Fermi’s Paradox বা ফার্মির হেঁয়ালি নামে।
এমন নামের ইতিহাসটা বেশ মজার। ১৯৫০ সালে লস আলামাস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় ইতালিয়ান পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি এবং তার সহকর্মী এমিল কনপিনস্কি, এডওয়ার্ড ট্রেলার এবং হার্বার্ট ইয়র্কের সাথে বসে খোশগল্প করছিলেন। তাদের গল্পের বিষয় ছিলো সাম্প্রতিক সময়ে শোনা যাওয়া UFO (Unidentified Flying Object) এবং এ নিয়ে অ্যালান ড্যানের ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে মজা করে দেখানো হয়েছিলো যে মিউনিসিপালের ট্র্যাশবক্স এলিয়েনরা চুরি করছিল। এই আলোচনার মধ্যেই ফার্মি হঠাৎ প্রশব ছুঁড়ে বসেন-“তারা কোথায়?” শোনা যায়, সেই সময়েই ফার্মি কিছু সম্ভাব্য মান নিয়ে দ্রুত হিসেব শুরু করেন, তারপর তিনি ঘোষণা করেন পৃথিবীতে ইতোমধ্যেই বহুবার এলিয়েন দেখা যাওয়ার কথা ছিলো!

এনরিকো ফার্মি
(১৯০১-১৯৫৪)
ফার্মির প্যারাডক্সের ভিত্তি
শুরুতেই বলেছি, আমাদের এই সৌরজগৎ অনন্য-এমনটা ভেবে আনন্দিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বরণ আমরা খুবই সাধারণ! আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথেই ২০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। ছায়াপথের সংখ্যাও মোটামুটি এমনই। সে হিসেবে নক্ষত্রের সংখ্যা মোটামুটি -। এত সংখ্যক গ্রহের মধ্যে সূর্যের অনুরুপ গ্রহই আছে ৫০০ বিলিয়নের মত, কারও কারও মতে ১০০ বিলিয়ন। তর্কের খাতিরে ‘অতি রক্ষণশীল’ সংখ্যাটা নিয়েই আমরা চিন্তা করি। PNAS (Proceeding of Natural Academy of Science) এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, মহাবিশ্বের গ্রহ ব্যবস্থাগুলোতে অন্তত ১% পৃথিবীর অনুরূপ গ্রহ আছে। সে হিসেবে অন্তত ১০০ বিলিয়ন বিলিয়ন পৃথিবীর অনুরূপ গ্রহ আছে!
আরেকটু সামনে বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক এই পৃথিবীরূপ গ্রহগুলোর মাত্র ১% এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে। তাহলেও মহাবিশ্বে সভ্যতার সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন বিলিয়ন!
সংখ্যাটা অনেক বড় মনে হচ্ছে? আচ্ছা শুধু মিল্কিওয়ে ছায়াপথের জন্যই হিসেব করা যাক। PNAS এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু মিল্কিওয়েতেই পৃথিবীর মত ১ বিলিয়ন গ্রহ আছে, তাদের ১% এ প্রাণের বিকাশ ঘটলেও সভ্যতার সংখ্যা ১০ মিলিয়ন!
ড্রেকের সমীকরণ
ফার্মির প্যারাডক্স সম্পর্কে অনেক গাণিতিক তত্ত্ব ও নীতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হলো ড্রেকের সমীকরণ।
ড্রেকের সমীকরণ থেকে আমরা বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়ার সম্ভাব্যতা জানতে পারি। সমীকরণটি হলোঃ
N = R * fp * ne * fl * fi * fc * L
N = এই মুহুর্তে যে কয়টি বুদ্ধিমান সভ্যতা মানুষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে তার সংখ্যা
R =প্রাণের বিকাশ ঘটতে পারে এমন নক্ষত্রের সংখ্যা
fp = এরকম নক্ষত্রগুলোতে গ্রহ ব্যবস্থা আছে এমন নক্ষত্রের সংখ্যার ভগ্নাংশ
ne = প্রতি গ্রহ ব্যবস্থায় প্রাণের বিকাশোপযোগী গ্রহের সংখ্যা
fl = এমন গ্রহগুলোতে প্রাণের বিকাশ ঘটতে পারে এমন গ্রহ সংখ্যার ভগ্নাংশ
fi = পূর্বের বিবেচনার গ্রহগুলোতে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে এমন গ্রহ সংখ্যার ভগ্নাংশ
fc = প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, এমন গ্রহগুলোর মধ্যে যে কয়টি গ্রহের সভ্যতা সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম তার ভগ্নাংশ
L = সিগন্যাল পাঠাতে সক্ষম এমন সভ্যতাগুলোর আয়ুষ্কাল।

বহির্জাগতিক প্রাণের সন্ধানে NASA-র পরিকল্পনাধীন প্রোব
তাহলে আর সবাই কোথায়?
খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গাণিতিকভাবে যদি এতগুলো সভ্যতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, তবে কেউ না কেউ তো অবশ্যই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা। কিন্তু তা যখন হয়ই নি, তাহলে কোথায় তারা?
মহাবিশ্বের মাপকাঠিতে আমাদের সৌরজগৎ মোটামুটি ‘কমবয়স্ক’-ই বলা চলে। সূর্যের চেয়েও মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে এমন নক্ষত্রের ব্যবস্থায় পৃথিবী-অনুরূপ গ্রহও মিলিয়ন বছর আগেই সৃষ্টি হয়েছে। সে হিসেবে, ওই গ্রহে গড়ে ওঠা সভ্যতা আমাদের চেয়ে মিলিয়ন বছর এগিয়ে আছে। যদি তা হয়েই থাকে, তাহলে তাদের সিগন্যাল আমাদের পক্ষে হয়তোবা বুঝা সম্ভব হবে না। যেমন, আমাদের কথা পিঁপড়ারা বুঝতে পারে না, যদিও তাদের নিজস্ব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। হয়তো এ কারণেই, মহাবিশ্ব থেকে পাওয়া অগণিত রেডিও সিগন্যাল থেকে বুদ্ধিমান সভ্যতাটির সিগন্যাল আমরা আলাদা করতে পারছি না। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের চেয়ে মিলিয়ন বছর পর শুরু হওয়া সভ্যতার ক্ষেত্রেও।
এ ধারণা থেকেই রুশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাই কার্দাশেভ সভ্যতা নিরূপণের একটি স্কেল প্রস্তাব করেন। কোন সভ্যতা শক্তি ব্যবহারে কতটা এগিয়েছে তার উপর ভিত্তি করে এই স্কেলটি প্রতিষ্ঠিত। এই স্কেলে বুদ্ধিমান সভ্যতাগুলোকে তিনটি টাইপে ভাগ করা হয়েছেঃ
টাইপ-১: এই শ্রেণীর সভ্যতাগুলো নিজেদের গ্রহের সকল শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা আছে। আমরা এখনো পুরোপুরিভাবে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক হতে পারি নি, তবে আমরা মোটামুটি কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কার্ল স্যাগান এর মতে আমরা এখন টাইপ ০.৭ সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।
টাইপ-২: এই শ্রেণীর সভ্যতা নিজের নক্ষত্রের বিকিরিত শক্তি পুরোটাই ব্যবহারে সক্ষম।
টাইপ-৩: এরা সবচেয়ে উন্নত শ্রেণী। এরা নিজস্ব নক্ষত্রই শুধু নয়, গোটা ছায়াপথের শক্তিই ব্যবহার করতে জানে।
তাত্ত্বিকভাবে হিসেব করা সম্ভাব্য বুদ্ধিমান সভ্যতাগুলোর অন্তত ১% ও যদি টাইপ-৩ এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মত যথেষ্ট পুরোনো হয়, তা হলেও অন্তত ১০০০ ধরনের টাইপ-৩ সভ্যতা পাওয়া যাওয়ার কথা, যারা ইতোমধ্যেই নিজস্ব ছায়াপথ, এমনকি পাশ্ববর্তী ছায়াপথেও নিজেদের কলোনি স্থাপন করতে পেরেছে।
কিন্তু তবুও আমরা তাদের খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
এর সম্ভাব্য কারণগুলোকে কয়েকটি সম্ভাবনায় ভাগ করা হয়ঃ
১. তারা এখানে ছিলো এবং প্রমাণও রেখে গেছে, অথবা তারা এখনও আছে। আমাদের সামনেই হয়তো তারা তাদের যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার এসব ফেলে রেখেছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না এগুলো আসলে কাদের।
কিন্তু এই ধারণার সমস্যা হলো, সেই বস্তুগুলো কোথায়?
২. অতি বুদ্ধিমান কোন সভ্যতা হয়তো আমাদের পরীক্ষামূলকভাবে একটা খাঁচায় বন্দী করে রেখেছে। এটা Zoo Scenerio বা Interdict Scenerio নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, চিড়িয়াখানায় খাঁচায় বন্দী কোন প্রাণী যেমন বাইরের প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না, তেমনি আমাদের সাথে অন্যান্য সভ্যতার যোগাযোগও কোন অতি উন্নত সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছে, যে কারণে আমরা কারও নাগাল পাচ্ছি না। কিন্তু এ তত্ত্বেরও কোন পরীক্ষালব্ধ্ প্রমাণ নেই।
৩. আমরা আসলে কোন ভিনগ্রহবাসীরই বংশধর! কিন্তু প্রশ্ন আসছেই-তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষরা কোথায়?
৪. তাদের আয়ুষ্কাল হয়তো আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু এর বিপক্ষে যুক্তি হলো, অতি উন্নত শ্রেণীর সভ্যতা স্ব-প্রজননশীল রোবোট তৈরি করতে পারার কথা (যা ব্রেসওয়েল-ফন নিউম্যান প্রোব নামে পরিচিত)। যদি কয়েক মিলিয়ন বছর আগেও এমন একটি প্রোব মহাবিশ্বে ছেড়ে দেয়া হয় তবে তা রেপ্লিকেট করতে করতে এতদিনে রীতিমত কলোনী বানিয়ে ফেলার কথা!
৫. হয়তো বহির্বিশ্বের সভ্যতা সিগন্যাল পাঠাচ্ছে কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার জন্য আমরা তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু সেক্ষেত্রেও, ১০০ মিলিয়ন বিলিয়ন সভ্যতার মাঝে অন্তত একটি সভ্যতা তো থাকা উচিত যারা জ্ঞানবিজ্ঞানে আমাদের সমমানের বা কাছাকাছি।
৬. তাদের হয়তো আলাদা গাণিতিক প্রক্রিয়া আছে। যদিও গণিতের ভাষা সবার জনেই একই হওয়ার কথা, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে যা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হবে। কিন্তু তা হলেও, সেই দুর্বোধ্য সংকেতই বা কোথায়?
৭. বহির্বিশ্বের সভ্যতাগুলো হয়তো এতই উন্নত, যে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজনই বোধ করে না। কিন্তু তাই বলে সবাই আমাদের চেয়ে উন্নত, এটা মানাও তো কষ্টকর!
৮. সম্ভবত অতি উন্নত সভ্যতাগুলো হয়তো নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে। সেটা হতে পারে অতি জনসংখ্যা, যুদ্ধবিগ্রহ, অতি উন্নত মারণাস্ত্রের ব্যবহার এসব কারণে। এটা অসম্ভব নয়, কারণ আমাদের সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আশঙ্কাজনকভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়ে যাওয়ার চিত্র আমরা নিজেরাই দেখতে পারছি।
এত সব সম্ভাবনা যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রে আর একটাই সম্ভাবনা থাকে- এই মহাবিশ্বে আমরাই সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা!
এর কারণ হিসেবেও দুটি সম্ভাবনা উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরাঃ
১. এই মহাবিশ্বে অন্য যেসব সভ্যতা আছে তারা এখনও আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মত অবস্থায় পৌঁছাতে পারে নি। যে কারণে তারা আমাদের বোধগম্য সিগন্যালও তারা তৈরি করতে পারে নি এবং আমাদের পাঠানো সিগন্যালগুলোও তারা বুঝতে পারছে না।
২. সর্বশেষ সম্ভাবনা হলো ‘এই মহাবিশ্বে আমরা অনন্য’। প্রাণের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রহব্যবস্থা, নক্ষত্রের আয়তন, গ্রহের গতি, মাধ্যাকর্ষণ বল, ছায়াপথের কেন্দ্র হতে প্রয়োজনীয় দূরত্ব- এত সব নিয়ামকগুলো সৌভাগ্যক্রমে শুধু পৃথিবীর জন্যেই মিলে গেছে!
বহির্জাগতিক প্রাণীরা আসলে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বরং দিন দিন প্রশ্ন বেড়েছেই। কিন্তু মানুষ থেমে থাকে নি। মহাবিশ্বের বুকে নিজের একাকিত্ব ঘুচাতেই যেন মরিয়া আমরা! আর তাইতো বহির্জাগতিক সংকেত পাওয়ার নেশায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। Search for Extraterrestrial Intelligence (SETI) ২০৩১ সাল পর্যন্ত নিজেদের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছে।
হয়তো সত্যিই একদিন আমাদের একাকিত্ব ঘুচে যাবে!
সোর্সঃ
আহমাদ আব্দুল্লাহ রিফাত
এডিটর
Open Space
ইমেইলঃ rifat@openspace.org.bd
ফেসবুকঃ www.facebook.com/ahmadabdullahrifat