চলুন একবার আকাশের দিকে তাকাই । কি দেখতে পাচ্ছেন ? বেশিরভাগ মানুষ বলবে তারা দেখছে । আবার যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারাগুলোর মাঝে কি আছে ? বেশিরভাগ মানুষ বলবে ফাকা জায়গা । কিন্তু আসল কথা হচ্ছে কি জানেন কোন ফাকা জায়গা নেই । যে জায়গাগুলোকে আপনার ফাকা জায়গা বলে মনে হচ্ছে আসলে তা গ্যাস দিয়ে ভর্তি । বিভিন্ন মৌলের গ্যাস দিয়ে ভর্তি । পার-সেন্টিমিটার কিউব ফাকা জায়গায় গড়ে ১০০ থেকে ১০০০ মৌলের ঘনত্ব রয়েছে । তার মানে ফাকা জায়গায় পাতলা গ্যাসের আস্তরন রয়েছে । কিন্তু এই মহাবিশ্ব বিশাল । অগনিত মৌল গ্যাসীয় অবস্থায় রয়েছে এই জায়গায় ।

চিত্রঃরাতের আকাশ
এই গ্যাস আস্তরনের মাঝে ৯২% হাইড্রোজেন এবং ৮% হিলিয়াম । এরা রাসায়নিক ভাবে নিস্ক্রিয় থাকে । খুবই খুবই অল্প পরিমান প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ অন্যান্য মৌলগুলো থাকে । যেমন-অক্সিজেন , কার্বন , নাইট্রোজেন ইত্যাদি । যদিও অন্যান্য উপাদানগুলো সুপ্যের মধ্যে ছিটেফোঁটা ভাবে থাকে তারপরেও এগুলাই সুপ্যের আসল স্বাদ দিয়ে থাকে ।
এখন পর্যন্ত এই মহাকাশে ১৮০ রকমের মৌল মাইক্রোওয়েভ স্পেক্ট্রার মাধ্যমে আবিষ্কার হয়েছে । মাইক্রোওয়েভ স্পেক্ট্রার মাধ্যমে এটা পারা গেছে । কারন যখন মৌলগুলো তাদের নিজ নিজ রাসায়নিক বন্ধনের চারদিকে ঘুরতে থাকে তখনই শক্তি উৎপন্ন হয় এবং এদের ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে গমন করে । ফলে মৌলটি মাইক্রোওয়েভ স্পেক্ট্রার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় ।

চিত্রঃমহাকাশে গ্যাস এবং ধূলিকণা
দুইটা কারনে এস্ট্রোকেমিস্ট্রির দিনে দিনে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বাড়ছে।
এক-এই মৌলগুলোর মাধ্যমে প্রানের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারনা পেতে পারি ।
দুই-এই মৌলগুলো এমন এমন রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করছে যা এই পৃথিবীতে বসে সেগুলো কল্পনা করা যায়নি । বিক্রিয়ার এক অংশ থেকে অন্য অংশে যেতে যেতে জট পাকিয়ে ফেলছে আমাদের । কখনো কখনো এগুলো আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হলেও এই মহাকাশে এই ধরনের জটিল বিক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে ।

চিত্রঃএস্ট্রোকেমিস্ট্রি
এস্ট্রো-কেমিস্টরা তাদের গবেষণায় নতুন আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে । এই নতুন আলোর মুখ হচ্ছে আটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে টেলিস্কোপ (আলমা)’ ।
ভূপৃষ্ঠে স্থাপিত পৃথিবীর বৃহত্তম টেলিস্কোপ ‘আটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে টেলিস্কোপ (আলমা)’ চালু হচ্ছে চিলির মরুভূমিতে। আলমার রয়েছে ৬৬টি রেডিও ডিশ।

চিত্রঃআটাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে টেলিস্কোপ (আলমা)
আলমা টেলিস্কোপ তৈরিতে খরচ হয়েছে ১৩০ কোটি ডলার। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার একাধিক দেশ যোগান দিয়েছে এই তহবিলের। চিলির আটাকামা মুরভূমিতে অবস্থিত এক পর্বত চূড়ায় তৈরি করা হয়েছে টেলিস্কোপটি।টেলিস্কোপটি ব্যবহার করে বিগ ব্যাংয়ের পরে সৃষ্টি হয়েছে এমন পুরনো এবং বহু দূরে অবস্থিত ছায়াপথেও নজরদারি করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। ফলে দূর-দূরান্তের নক্ষত্রকে ঘিরে তৈরি হতে থাকা নতুন নতুন গ্রহের গঠন প্রক্রিয়াতেও নজর রাখা সম্ভব হবে।
পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী আলমা। পরিষ্কার ছবি পাবার জন্য টেলিস্কোপটিকে স্থাপন করা হয়েছে ভূপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার মিটার উঁচু পর্বত চূড়ায়। এই উচ্চতায় টেলিস্কোপটিতে কর্মরত বিজ্ঞানীদেরও বেশ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। অনেক সময় শ্বাস নেবার জন্য নির্ভর করতে হবে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন সরবরাহের ওপর।
২০০৯ সাল থেকেই আলমা-র প্রথম অ্যান্টেনাগুলো আশ্চর্য সব ছবি দিয়ে যাচ্ছে৷ শীঘ্রই এই অবজারভেটরি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণাই পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে বলে গবেষকরা মনে করেন৷ মহাশূন্যের উৎস এবং ঐ অসীমে অন্য কোথাও জীবন ও জীব আছে কিনা, মানুষের এই অনন্ত জিজ্ঞাসার উত্তরও হয়তো আলমা একদিন দিতে পারবে!
এর আগের টেলিস্কোপগুলো এতটা গুনগত ছিল না ।
আপনি যদি এর আগের টেলিস্কোপ দ্বারা নীহিরাকায় ফোকাস করেন তাহলে ধূলিকণা ছাড়া কিছু দেখতে পারবেন না । খুব বেশি হলে ছোট ছোট সরল যৌগ যেমন কার্বন মনো অক্সাইড , হাইড্রোজেন সায়ানাইড দেখতে পারবেন । কিন্তু জটিল যৌগ কখনই দেখতে পারবেন না । কারন জটিল যৌগের অসংখ্য বন্ধন জুড়ে তাদের ফ্রিকোয়েন্সি এতটাই বিস্তৃত থাকে যে ঘূর্ণায়মান শক্তি অনেক বেশি বিক্ষিপ্ত হয় ।

চিত্রঃবিভিন্ন টেলিস্কোপের মধ্যকার তারতম্য
কিন্তু আলমাতে যেসব টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয় তা দিয়ে জটিল যৌগ খুজে পাওয়া সম্ভব । এখন পর্যন্ত এই টেলিস্কোপগুলো দ্বারা গ্লাইকোলেলডিহাইড এবং অ্যাসিটোন খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে । এই সব যৌগের মধ্যে ৮ থেকে ১০ টা পরমানু থাকে । আলমার গবেষকরা আশা করছে যে আগামীতে সরল শুগার এবং জৈব এসিডগুলো খুঁজে পাবে । আর যদি একবার পেয়ে যায় তাহলে এটা আমরা বিশ্বাস করা শুরু করব যে পৃথিবীর বাইরে জীবনের উৎস রয়েছে ।

চিত্রঃঅ্যাসিটোন

চিত্রঃগ্লাইকোলেলডিহাইড
রাসায়নিক বিক্রিয়া বলতে আমরা বুঝি একটা মৌল বা যৌগের সাথে অন্য একটি মৌল বা যৌগের বিক্রিয়া । এটা একটা লাইনে লিখা যায় । যেমনঃ-
2H₂ + O₂ = 2H₂O
দেখে আপনার মনে হবে যে পানি মাত্র এক ধাপেই উৎপন্ন হয় । কিন্তু আসলে তা হয় না । এর মাঝে আরও কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন হয় ।যেগুলো এই পৃথিবীর রসায়ন ল্যাবে খুব দ্রুত এবং খুবই অল্প সময়ে সম্পন্ন হয় । কিন্তু মহাকাশে এই মাধ্যমিক ধাপ গুলো ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয় । একটা ধাপ থেকে অন্য ধাপে যেতে অনেক বেশি সময় লাগে । এটা আলমা মাইক্রোওয়েভ ট্রেসের মাধ্যমে জানতে পারা যায় ।
মিথাইল ফরম্যাট । পৃথিবীতে এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয় । পৃথিবীতে মিথাইল ফরম্যাট তৈরি করা হয় মিথানল এবং ফরমিক এসিডের বিক্রিয়ার মাধ্যমে । এটি আবার মিথানল এবং কার্বন মনো অক্সাইড দ্বারাও তৈরি করা যায় । কিন্তু মহাকাশে এই মিথাইল ফরম্যাট এভাবে তৈরি হয় না ।

চিত্রঃমিথাইল ফরম্যাট
C2H5OH + HCOOH = HCOOCH3
C2H5OH+ CO = HCOOCH3
মহাকাশে নতুন একটি বিক্রিয়া আবিষ্কার করা হয়েছে । সেখানে দেখা গেছে যে মিথাইল ফরম্যাট ফরমিক এসিড এবং অস্থায়ী জটিল যৌগ দ্বারা তৈরি হয়েছে । এই অস্থায়ী জটিল যৌগ টি আবার মিথানল এবং হাইড্রোজেনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় । এই বিক্রিয়াটি পৃথিবীতে কেমিস্ট্রি ল্যাবে সম্পন্ন করা হয় নি কখনও । এমনকি এই বিক্রিয়া সম্পর্কে এর আগে কারও ধারনাও ছিল না ।
ডঃ অ্যান্থনি রেমিজান আমেরিকাস ন্যাশনাল রেডিও এস্ট্রোনমি অবজারভেটরি হিসেবে আলমা তে কাজ করছেন । তিনি মহাকাশে মিথাইল ফরম্যাট কিভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এর নতুন একটি বিক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন ।

চিত্রঃডঃ অ্যান্থনি রেমিজান
সম্ভবত এই বিশেষ আবিস্কারের কোন বাস্তব রূপ থাকবে না । কারন আমাদের জানা উৎপাদনকারী বিক্রিয়াগুলো অনেক বেশি কার্যকরী এবং সহজসাধ্য । তাই আমাদের জানা বিক্রিয়ারগুলোর মাধ্যমে মিথাইল ফরম্যাট উৎপাদন করা অনেক সহজ ।

চিত্রঃ এই মহকাশ হচ্ছে একটি বিশাল রসায়ন সেট
রসায়ন ল্যাবে মহাকাশে যে পরিবেশ থাকে সেই পরিবেশ আনতে পারলে গবেষণা করা অনেক বেশি সহজ হবে । এর মাধ্যমে আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারবো একটি যৌগ কতগুলো প্রসেস দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে । এতে সুবিধা হবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের । তারা ঘরে বসেই তাদের ফর্মুলাগুলো আবার নতুন করে সাজাতে পারবে । সুতরাং, এই মহাকাশ হচ্ছে বিশাল রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভাণ্ডার । একটি বিশাল রসায়ন সেট ।

চিত্রঃ টেস্টটিউব
যদি এমন হয়, তাহলে আকাশে যে টেস্ট টিউব আছে তার মূল্য সত্যিই প্রমাণিত হবে।
সুত্রঃ economist.com, space.com, Wikipedia.com, telegraph.co.uk, quora.com
2 comments
wow
valo hoise .