ওয়ার্মহোল হল তাত্ত্বিকভাবে মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি স্থানের বা স্থান-কালের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য তৈরি একটি টানেল স্বরূপ। এটির মাধ্যমে মহাবিশ্বের একটি স্থান থেকে অন্য একটি স্থানে কম সময়ের মাঝেই ভ্রমণ করা যায়। কেননা এটি প্রায় কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষের পার্থক্যে থাকা মহাবিশ্বের দুটি বিন্দুকে মাত্র কয়েক মিটারের একটি টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত করে দিতে পারে!! এদিকে আমরা ফার্মাটের সূত্র থেকে জানি যে, আলো সর্বদা সরল পথে চলে। তাই ওই দুই বিন্দুর একস্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে আলোর কয়েক বিলিয়ন বছর সময় লাগলেও, আপনি ওয়ার্মহোল ব্যাবহার করে অতি সহজেই মাত্র কয়েক মুহূর্তেই এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে চলে যেতে পারবেন। ব্যাপারটা অনেকটাই আলোর চেয়ে বেশী বেগে চলার মতো, তবে অবশ্যই আলোর চেয়ে বেশী দ্রুতি চলা নয়!!

ছবিঃ একটি কাল্পনিক ওয়ার্মহোল
ওয়ার্মহোলের ধারণাটি মূলত আমেরিকান গণিতবিদ এডওয়ার্ড কাসনার এর কাসনার মেট্রিক্স ব্যাবহার করে আইন্সটাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধানের মাধ্যমে এসেছিল এবং পরবর্তীতে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল এহরেনফেস্ট এর এহরেনফেস্ট প্যারাডক্স এর গঠনের উপর দাঁড়িয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ব্ল্যাকহোলের মতোই আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সমাধানের মাধ্যমেই ওয়ার্মহোলের উৎপত্তি হলেও, নানান দিক দিয়েই তাদের পার্থক্য অনেক।
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবর হচ্ছে স্পেস টাইমের মধ্যকার এমন একটি অংশ, যেখানে মহাকর্ষের প্রভাব এতই বেশি যে, সেখান থেকে মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ বেগে চলমান তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বা আলো পর্যন্ত মুক্তি পেয়ে ফিরে আসতে পারে না। এমনকি ব্ল্যাকহোলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া আলো বা নক্ষত্রের কোনও প্রকার হদিস বের করা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ওয়ার্ম হোল হচ্ছে একটি থিওরিটিকাল প্যাসেজ অথবা টানেল যা স্পেসটাইমে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতে একটি শর্টকাট তৈরি করে এবং যার ফলস্বরূপ ইউনিভার্সের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমন টা সময়ের সাথে কমে যায়।

চিত্রঃ ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণবিবর। ক্রেডিটঃ Physics.Org
ওয়ার্মহোল এর আরেক নাম আইন্সটাইন রোজেন ব্রীজ। ওয়ার্মহোল হল এক ধরনের সেতু বা সুরঙ্গ যা মহাশূন্যে সময়ের কাল্পনিক চিত্র বর্ননা করে। এর দুই প্রান্ত মহাশূন্যের সময়ের দুই অবস্থানে থাকে। চারের চেয়ে বেশি মাত্রায় এটি অদৃশ্য। সহজ ভাষায় এটা হল দুই মাত্রার তলে দেখা মহাশূন্যের সময়। তল টি যদি তৃতীয়মাত্রায় ভাজ হয়ে আসে তখন ওয়ার্মহোল সেতুর মত দেখায়।
জটিল লাগছে? সহজ করে বলছি। ধরুন আপনি বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাবেন। অনেক দূরের পথ। বিমানে করে যেতে আসতে ১৩-১৬ ঘন্টা লেগে যায়। তো আপনি একটা সুড়ঙ্গ এর মত তৈরি করলেন যার মাধ্যমে আপনি দুই ঘন্টায় সেখানে পৌছে গেলেন। ওয়ার্ম হোল অনেক টা এইরকম ই। তবে এর গন্তব্যস্থল আপনার ইচ্ছামত নয়। এটা তখনি সম্ভব যখন আপনি নিজে সেটা তৈরি করবেন।
ওয়ার্ম হোলের ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করি। একটা কাগজ নিই। কাগজের লম্বালম্বি দুই প্রান্তে দুটো ছোট্ট বৃত্ত আঁকি। এবার কাগজটা মাঝ বরাবর ভাঁজ করে বৃত্ত দুটো এক করে কাগজটা ফুটো করি। ফুটো দুটো যোগ করে একটি ছোট টানেলের মতো তৈরি করি। এটিই হচ্ছে একটি ওয়ার্ম হোল। খেয়াল করি। কাগজটা যখন সমান্তরাল ছিল তখন বৃত্ত দুটোর মধ্যে দূরত্বটা অনেক ছিল অথচ ভাঁজ করার পর দূরত্বটা অনেক কমে গেল! এটিই ওয়ার্ম হোলের মূল ধারণা এবং প্রয়জনীয়তা আমাদের কাছে।
ইতিহাসঃ
ঘটনাটি ১৯৩৫ সালের দিকের, আইন্সটাইন ও ন্যাথান রোসেন একটি গবেষনাপত্রে আন্তঃমহাবিশ্বের সংযোগ তত্ত্বের উপর আলোকপাত করেন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৈদ্যুতিক রৈখিক শক্তির মাধ্যমে গঠিত স্থানকালে টানেলের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক কণিকাগুলো যেমন ইলেকট্রনকে ব্যাখ্যা করা। এই গবেষনাপত্রের মাধ্যমেই বিজ্ঞানমহলে ওয়ার্ম হোলের ধারনা পাওয়া যায়।

আইন্সটাইন

ন্যাথান রোসেন
আইনস্টাইনের এই সমীকরণের অনেকগুলো সমাধান আছে… সে জন্য আমাদের আগে ইভেন্ট হরাইজনের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। ইভেন্ট হরাইজন মূলত ব্ল্যাকহোলের চারপাশের পরিধি, যেখান থেকে আমরা কোনো প্রকার কণা বা তরঙ্গ বের হয়ে আসতে দেখি না। এখানে যদি আমরা আইনস্টাইন রোজেন ব্রিজ ইকুয়েশন প্রয়োগ করি তবে এখান থেকেই বেড়িয়ে আসে শোয়ার্ডসচাইল্ড ওয়ার্মহোল । ১৯১৬ সালে কার্ল শোয়ার্ডসচাইল্ড এই সমাধানটা দিয়েছিলেন। আর ১৯৮৮ সালে ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কিপ থোর্ণ, স্পেসটাইম ফুটো করে এক সময় হতে অন্য সময়ে চলে যাবার একটা উপায়ের কথা বলেছিলেন। একে নাম দেয়া হয়েছে ট্র্যান্সভার্সিবল ওয়ার্মহোল ।
জন্ম:
ওয়ার্মহোল বলতে এমন একটি কাল্পনিক সুড়ঙ্গকে বুঝানো হয় যার সাহায্যে ব্ল্যাকহোল এবং হোয়াইটহোলের সংযোগ ঘটেছে।
স্থানকালের অসীম ঘনত্বের চুড়ান্ত পর্যায় হচ্ছে সিঙ্গালুরাটি যা আমরা ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে রয়েছে বলে ধারণা করে থাকি। ধারণা করা হয় এটি স্থান-কাল চাদরে সর্বোচ্চ পরিমাণ বক্রতা ঘটাতে সক্ষম। তাই স্থানকালের দুটি ভিন্ন বিন্দুতে এই সিঙ্গালুরাটি থাকলে তারা যদি একে অপরের সংস্পর্শে এসে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় তবে একটি ওয়ার্মহোলের সৃষ্টি হবে। এখানে ব্ল্যাকহোল ও হোয়াইটহোলের জন্য স্থানকালে দুটি সিঙ্গালুরাটি বিন্দুর সৃষ্টি হয় এবং এরা পরস্পর মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টির মাধ্যমেই ওয়ার্মহোলের জন্ম হয়।
আকৃতিঃ
ওয়ার্ম হোলের দুইটি মুখ এবং একটি গলা রয়েছে। ওয়ার্মহোল যেহেতু স্থানকালের মাঝে ছিদ্র সেহেতু আমরা জানি স্থানকাল হচ্ছে চতুর্মাত্রিক ধারণা যার মাঝে একটি ত্রিমাত্রিক স্থান রয়েছে। আর ত্রিমাত্রিক স্থানে কোন ছিদ্র করলে তার আকার হবে একটি গোলকের মতো। সুতরাং ওয়ার্মহোলের বাইরের আকৃতি ধারণা করা হচ্ছে গোলকের মতো। কিন্তু ওয়ার্মহোলের ভিতরের আকৃতি কেমন হবে তা জানা যায়নি। তবে ধারনা করা হয়, আমাদের মস্তিষ্ক যেহেতু তিনমাত্রায় বিচরন করে সেহেতু আমাদের চিন্তাশক্তিও এই তিনমাত্রার মাঝেই সীমাবদ্ধ। তাই ওয়ার্মহোলের ভিতরের জগত আমাদের কল্পনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও আমরা যদি ওয়ার্মহোলের ভিতরে প্রবেশ করতে পারি তবে ধারণা করা হয় সব কিছু আমাদের কাছে ঘোলাটে মনে হবে। কেননা সেখানে সবকিছু থাকবে উচ্চমাত্রার যা আমাদের অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
বৈশিষ্ট্যঃ
১। এটা খুবই অস্থায়ী ।
২। যদি এর ভিতর দিয়ে একটি আলোক কনাও ঢুকে তাহলে এটি সাথে সাথেই বিনষ্ট হয়ে যাবে ।ওয়ার্মহোল তত্ত্বীয়ভাবে একটি সংক্ষিপ্ত গমনপথে স্থান-কালের ভেতর দিয়ে মহাবিশ্বের এক স্থান থেকে দীর্ঘ দূরত্বে অন্য স্থানে ভ্রমণ অনুমোদন করে। কিন্তু মানুষের জন্য এই ভ্রমণ কাজটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে, কারণ উচ্চমাত্রার বিকিরণ এবং বাইরের পদার্থের সঙ্গে বিপজ্জনক সংযোগের দরুন এসব ওয়ার্মহোল যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।

ছবিঃ ওয়ার্মহোলের ভিতরের টানেল।
৩। তারপরেও ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলে এর অপর প্রান্তে আমরা নিজেকে অন্য স্পেস এবং সময়ে আবিষ্কার করব। যদিও এই ভ্রমণটি আমাদের কাছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মনে হলেও নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি কয়েক শতক পরে।
৪। আমরা যদি একটি ওয়ার্মহোলের ভেতরে প্রবেশ করি তবে নিজেকে কোন ভিন্ন মাত্রায় দেখতে পাবো। এই বিষয়টিকে তাত্ত্বিকভাবে বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স। আমাদের জগতটি হলো ত্রিমাত্রিক জগত আমরা কোন কিছুর অবস্থান নির্ণয় করি তিনটি মাত্রার মাধ্যমে, এই তিনটি মাত্রা হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে মাল্টিপল ইউনিভার্সের সাথে সংযুক্ত হওয়া সম্ভবপর হতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বিস্ময়কর ধারণা হলো প্যারালাল ইউনিভার্স কিংবা মাল্টিপল ইউনিভার্স। ধারণা করা হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর সময় ইনফ্লেশন বা বুদবুদের মাধ্যমে এই প্যারালাল ইউনিভার্সের সৃষ্টি।
৫। ওয়ার্মহোল হচ্ছে একটি চতূর্থমাত্রিক স্থানকালের মাঝে তৈরী গর্ত যা স্থানকালের দুটি ভিন্ন স্থান ও সময়কে সংযুক্ত করে। স্টিফেন হকিং এর মতে ব্ল্যাকহোলের ভিতর দিয়ে কোনো কিছু পতিত হলে তা একেবারে হারিয়ে যায় না, একটি কণিকারূপে ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত হয়। এই কণিকা ওয়ার্মহোলের দ্বারাই হোয়াইটহোলের মাধ্যমে নির্গত হয়ে থাকে। এছাড়াও ধারনা করা ওয়ার্মহোল এক মহাবিশ্বের সাথে অন্য মহাবিশ্বেরও সংযোগ স্থাপন করে। ওয়ার্মহোল তৈরী হয় সিঙ্গালুরাটি বা অদ্বৈত বিন্দুর মাধ্যমে। সিঙ্গালুরাটি হচ্ছে সেই বিন্দু যেখান থেকে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়।
শ্রেণিবিভাগঃ
দুই ধরনের ওয়ার্মহোল থিওরিটিক্যালি পাওয়া গিয়েছে ।
১। লরেন্টজান ওয়ার্মহোল (সাধারণ আপেক্ষিকতা) যা প্রধানত আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বে প্রমান করা হয়েছে ।
২। ইউক্লিডিয়ান ওয়ার্মহোলস (কণা পদার্থবিদ্যা) যা প্রধানত কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বে প্রমান করা হয়েছে ।
কৃত্রিম ওয়ার্মহোলঃ
পৃথিবীতে ওয়ার্ম হোল তৈরী করার জন্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছে । স্পেনের Autonomous University of Barcelona এর রিসার্চাররা “ম্যাগনেটিক ওয়ার্মহোল” তৈরি করতে পেরেছে বলে দাবি করেছে । তাত্ত্বিকগণ বিশ্বাস করতেন যে ওয়ার্ম হোল শুধুমাত্র একটি তাত্ক্ষণিক সময়ের জন্য বিদ্যমান হতে পারে এবং ওই সময়ে যে কেউ সিঙ্গুলারিটির মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারবে ।

ছবিঃ কৃত্রিম ওয়ার্মহোল
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ওয়ার্মহোল শুধু মহাবিশ্বের দুটি পৃথক অঞ্চলকেই সংযুক্ত করে না বরং দুটি মহাবিশ্বকেও সংযুক্ত করতে পারে। এই ওয়ার্মহোল ব্যবহার করে আলোকবর্ষ দূরে থাকা এক সৌরজগৎ থেকে অন্য সৌরজগতে মুহূর্তের মধ্যেই যাওয়া সম্ভব! কিন্তু এই ওয়ার্মহোল এখনো একটি কাল্পনিক বস্তু! এটিকে আমরা একটি কাল্পনিক গোলক হিসেবে চিন্তা করে থাকি। আর এটির মজা উপভোগ করার জন্য ক্রিস্টোফার নোলান এর ‘ইন্টারস্টেলার’ মুভি দেখার বিকল্প নেই।
সূত্রঃ www.universetoday .com , http: physics.about.com , Wikipedia , বিভিন্ন ব্লগ
2 comments
অসাধারণ
আরও চাই