ছোট বেলায় ওই দূর আকাশের চাঁদমামার দিকে তাকিয়ে চাঁদের চরকি কাঁটা বুড়ির কথা কল্পনা করেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক কোন বুঝে পুরো চাঁদকে মামা বানিয়ে ভিতরে একজন বুড়ি বসিয়ে দেওয়া হলো তা কখনই আমার বুঝে আসে নি!! যাই হোক, আকার-আকৃতি এবং বয়স দেখে মানুষের বিচার করার প্রবণতা আজকের নয়।বহু যুগ ধরে এটি চলে আসছে এবং এটির গুরুত্ব মোটেও কম নয়। যেমন ধরা যাক, আইনস্টাইন নিজেই তো আকার-আকৃতি কিংবা স্পেস আর সময় যে একই জিনিস তা প্রমাণ করে বিশাল সুনাম কুড়িয়েছেন!!চিন্তা করুন তো, আপনার মাথার কাছ দিয়ে একটি নতুন মহা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার চলে গেল!
তাই চলুন আজকে চাঁদের পেছন ছেড়ে পুরো বিশ্বলোকের বয়স এবং ব্যাপ্তি নিয়ে আলোচনা করি। কে বলতে পারে, এটি হয়তোবা আপনার মাথার কাছ দিয়ে নয় বরং মধ্য দিয়েই যাবে!!
প্রযুক্তির বর্তমান বিবর্তনে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বিগ ব্যাং এর প্রায় পরমুহূর্তেরই চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে পেরছে।এ থেকে আমরা বলতে পারি যে, বিগ ব্যাং পরবর্তী প্রায় সম্পূর্ণ মহাবিশ্বই আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি তার প্রসারণ, আকার-আকৃতি ইত্যাদির মতো আরো কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সত্যি বলতে, বিজ্ঞানীগণ এখনো সঠিকভাবে বলতে পারবে না যে, এই মহাবিশ্বের সঠিক আয়তন কত। কেননা আমরা সাধারণত ততটুকুই পর্যবেক্ষণ করতে পেরছি যেখানকার আলো আমাদের টেলিস্কোপে ধরা দিয়েছে।কিন্তু এমন ও তো কোন নক্ষত্র, ছায়াপথ কিংবা আরেকটি মহাবিশ্ব থাকতে পারে, যেখানের আলো এখনো আমাদের টেলিস্কোপে এসে ধরা দেয় নি!!তাই আমরা মহাবিশ্বের যে আয়তন খোঁজার চেষ্টা করবো তা কেবলমাত্র আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই রয়েছে।

Credit: America Space
ইউরোপীয়ান মহাকাশ সংস্থা কতৃক পরিচালিত প্ল্যাঙ্ক স্পেস মিশন ২০১৩ সালে মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরনো আলোটির সবচেয়ে নিখুঁত একটি নকশা তৈরি করেছিল।এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের।এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর কিংবা তার বেশী।

সদ্য আবিষ্কৃত পৃথিবী থেকে সর্বাধিক দূরত্বের গ্যালাক্সি যা মহাবিশ্বের মাত্র ৪০০ মিলিয়ন বছর সময়েও ছিলো Credit: National Geographic
বিজ্ঞানীরা এই বয়স হিসেব করেছিলেন মহাবিশ্বের শুরুর দিক থেকে আসা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড লাইট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। নাসার মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস লরেন্স এর ভাষ্যমতে, “ কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড লাইট হচ্ছে বহু দূরের পথিক।যখন এটি আসে তখন এটি আমাদের পুরো মহাবিশ্বের গল্প শুনিয়ে যায়।

প্ল্যাংক অবজারভেটরির পর্যবেক্ষণে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের (CMB) একটি চিত্র. Credit: ESA
দূরত্বের সাথে আলোর বেগ এর সম্পর্কের দরুণ আমরা বলতে পারি যে,আমাদের বিজ্ঞানীগণ ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের যেকোনো অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।এটি অনেকটা খোলা বিশাল সমুদ্রের মাঝে একটি জাহাজের মতো। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীতে বসে তাদের টেলিস্কোপ এর সাহায্যে যেকোনো দিকে ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।এ থেকে আমরা পর্যবেক্ষণীয় মহাবিশ্বকে ১৩.৮ আলোকবর্ষের একটি গোলক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।সেক্ষেত্রে আমাদের পর্যবেক্ষণীয় মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ২৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আবার জানেন যে, মহাবিশ্ব প্রতিনিয়তই প্রসারিত হচ্ছে। তাই বিগ ব্যাং এর সময় যে বিন্দু পৃথিবীতে হতে ১৩.৮ আলোকবর্ষ দূর অবস্থান করেছিল সেটি বর্তমানেও নিশ্চয়ই ওই একই দুরত্বে থাকবে না।
যদি মহাবিশ্বের ইনফ্লেশন কিংবা স্ফীতি একটি ধ্রুব গতিতে ঘটে থাকে, তবে ওই বিন্দু আজ পৃথিবী হতে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত!!তাই যদি পৃথিবীকে কেন্দ্র হিসেবে ধরি তবে মহাবিশ্বের সমগ্র ব্যাস দাঁড়ায় প্রায় ৯২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ!! কিন্তু সাগরের মধ্যে একটি জাহাজে থেকে তীরের দেখা না পাওয়ার মানে এই নয় যে জাহাজটি ঠিক সাগরের মাঝখানে রয়েছে।ঠিক একইভাবে আমরা বলতে পারি যে, মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত দেখতে না পাওয়ার মানে এই নয় যে, আমরাই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছি। তাই বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন উপায়ে মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি পরিমাপের চেষ্টা চালিয়েছেন।তাছাড়া মহাবিশ্বের কিভাবে স্ফীতি হচ্ছে সেটিও এক বিশাল রহস্য।যদিও আমরা এই স্ফীতির হার একটি ধ্রুবক ধরে মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হিসেব করেছিলাম, অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন এই হার দিন দিন কমছে।কেননা যদি মহাবিশ্বের স্ফীতি সৃষ্টির শুরুর দিকের মত অর্থাৎ আলোর বেগের সমান হত তবে মহাবিশ্বের বর্তমান ব্যাস হত প্রায় ১০^২৩ আলোকবর্ষ!!!!মিহরান ভার্দানিয়ান এর নেতৃত্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর একদল গবেষক বায়েসিয়ান গড় মডেল ব্যাবহার করে সবগুলো পরিমাপের একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন।তাদের হিসেব মতে,বর্তমান মহাবিশ্বের ব্যাস আমাদের পর্যবেক্ষণীয় মহাবিশ্বের চেয়ে অন্তত ২৫০ গুন বেশী এবং তা অন্তত ৭ ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে রয়েছে।
এছাড়াও মহাবিশ্বের আয়তন অনেকাংশেই তার আকৃতির উপর নির্ভর করে থাকে।বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য ধারণা করেন যে, মহাবিশ্ব হয়তো একটি গোলকের মত বদ্ধ, অসীম এবং ঘোড়ার জিনের মত ঋণাত্মকভাবে বক্র কিংবা সমতল এবং অসীম।

মহাবিশ্বেরে জ্যামিতি
বর্তুলাকার মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে, একটি সসীম মহাবিশ্বের জন্য অবশ্যই একটি সসীম আয়তন রয়েছে যা পরিমাপ করা সম্ভব। কিন্তু সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি অসীম মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কোন প্রকার আয়তন থাকা সম্ভব নয়।নাসার ভাষ্যমতে বিজ্ঞানীরা জানেন যে, মহাবিশ্ব সমতল, যা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ০.৪%। এটিই আমাদের মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা বদলে দিতে পারে। নাসা তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে যে, “যেহেতু পৃথিবী সমতল তাই এর ব্যাপ্তি অসীম।আমরা মহাবিশ্বের কেবলমাত্র একটি সসীম আয়তন পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সব মিলিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মহাবিশ্বের যেটুকু অংশ আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারি তার চেয়ে মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি আরও অনেকাংশেই বেশী।“
আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক মহাবিশ্বের এই বিশাল ব্যাপ্তি কল্পনা করতে সবসয়ই হিমশিম খেয়ে থাকে।কেননা আমরা আমাদের পৃথিবীতে চারপাশে যা দেখে থাকি এবং এমনকি পৃথিবী নিজেও মহাবিশ্বের এই অপরিমেয় মাপকাঠির তুলনায় খুবই নগণ্য।তবে এই নগণ্য অংশটুকু নিয়েই আমাদের সব ভালোলাগা এবং ভালবাসা।এই নগণ্য অংশেই কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রতিমুহূর্তের সপ্ন এবং আশা নিয়ে বাঁচে।তাই এই নগণ্য অংশটুকুকেও সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখা আমাদেরই দায়িত্ব।আর আপনার জন্য আপাতত দায়িত্ব হলো, চিন্তা করতে থাকুন, মাথার মধ্য দিয়ে গেল? নাকি আবারো কাছ দিয়ে?!!
Source:
- Space.com
- Nasa
- ESA
- PBS
- Space Time
- Physics.org