প্রাচীনকালে যখন মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে সহস্র কোটি তারা আবিষ্কার করেছে, তখন থেকেই কনস্টেলেশনের জন্ম। কনস্টেলেশন বা তারামন্ডল হল অনেকগুলো তারা বা নক্ষত্রের পুঞ্জ, যেগুলোকে প্রাচীন মানুষ বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রের আকৃতি দিয়েছিল।সমগ্র আকাশের তারাগুলোকে মোট ৮৮ টি তারামন্ডলে ভাগ করা হয়েছে। সেই ৮৮ টি তারামন্ডলের মধ্যে অরায়ন বা কালপুরুষ তারামন্ডল অন্যতম। অরায়নের একটি বিশেষ দিক হল এই তারামন্ডলটি চেনা সহজ এবং সেটি চিনতে পারলে তা থেকে সহজেই অন্যান্য তারামন্ডলকে সনাক্ত করা যায়।

অরায়ন তারকামন্ডল
অরায়ন নামটি এসেছে গ্রীক মিথোলজি থেকে, যার অর্থ হান্টার বা শিকারী । বাস্তবিকভাবে অরায়ন তারামন্ডলকে এমন এক চরিত্র কল্পনা করা হয়, যে স্বর্গের দুই কুকুর ক্যনিস মেজর ও ক্যনিস মাইনর কে সাথে নিয়ে স্বর্গের ষাঁড় টরাসের সাথে ক্লাব হাতে যুদ্ধ করছে।অরায়ন তারামন্ডলের নামকরনের পেছনে রয়েছে এক বিশাল ইতিহাস। প্রাচীন গ্রীক, মিশরীয় ,রোমান, আরব বিভিন্ন সভ্যতাতে অরায়নকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী অরায়ন হল একজন গ্রীক হিরো, যার মৃত্যুর পর দেবতা জিউস তাকে রাতের আকাশে স্থাপন করেন । বলা হয়, দেবতা আরটেমিসের নির্দেশে স্করপিয়ন অরায়নকে হত্যা করে, তাই স্করপিয়ন ও অরায়ন কে আকাশের দুটি বিপরীত প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে। প্রাচীন মিশরে অরায়নকে দেবতা ওসিরিসের সাথে তুলনা করা হয়েছে । মিশরের গীজার তিনটি পিরামিড, মেঙ্কার, খাফরে ও খুফুর পিরামিডের অবস্থান দেখলে দেখা যাবে পিরামিড তিনটি আসলে অরায়ন বেল্টের তিনটি তারাকে অনুসরন করে। আশ্চর্যজনকভাবে, ওসাইরিস হল পুনরুত্থানের দেবতা। আর পিরামিড পুনরুত্থানকেই নির্দেশ করে। আবার, অরায়ন তারামন্ডলের পাশেই ক্যনিস মেজর তারামন্ডলের তারা সিরিয়াস রয়েছে, যা আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা । মজার ব্যপার হল সিরিয়াসের নামকরন হয়েছিল ওসাইরিস থেকে। সুমেরিয়ান মিথোলজিতে অরায়নকে স্বর্গের ষাঁড়ের সাথে যুদ্ধরত হসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এমনকি বাইবেলেও তিনবার অরায়ন তারামন্ডলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অরায়ন সকল সভ্যতাতেই একটি গুরুত্বপূর্ন তারামন্ডল হসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে।

আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা সিরিয়াস
খালি চোখে পৃথিবীর প্রায় সব স্থান থেকেই নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই শীতকালীয় তারামন্ডল কালপুরুষ বা অরায়নকে স্পষ্টই দেখা যায়। অরায়ন চেনার উপায় খুব সহজ,রাতের আকাশে পর পর তিনটি পাশাপাশি খুব স্পষ্ট উজ্জ্বল তারা দেখলেই বোঝা যায়, সেটা অরায়নের অংশ। সেই পর পর তিনটি পাশাপাশি তারাকে বলা হয় অরায়ন বেল্ট। বেল্টের তারার নামগুলো হল আলনিয়াক , আলনিলাম ও মিনতাকা ।অরায়ন বেল্ট ও তার উত্তরে ও দক্ষিনে দুটি করে মোট সাতটি তারা মিলেই অরিয়ন তারামন্ডল। অরায়নের পশ্চিমে পায়ের কাছের তারাটির নাম রাইজেল, যা মন্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা। এর পূর্বদিকে পায়ের তারা হল সাইফ। বেল্টের উপরে কাধের লাল রঙের তারা হল বেটেলজিউস, যা একটি রেড জায়ান্ট। এর পশ্চিমে আছে বেলাট্রিক্স । খালি চোখে অরায়নের এই সাতটি প্রধান তারাই সনাক্ত করা গেলেও অরায়ন তারামন্ডলটিতে মোট তারা আছে ৭৭ টি , যা টেলিস্কোপে দেখা যায়। অরায়নের একটি কৌতুহল উদ্দীপক জিনিস হল অরায়ন নেবুলা, যা তারাদের জীবনকাল গবেষণায় খুব গুরুত্বপূর্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অরায়ন নেবুলা অরায়নের পায়ের কাছে অবস্থিত, যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তারা সৃষ্টি হচ্ছে। এই নেবুলার নাম m42, যা প্রায় ৭০০ নতুন তারার জন্মস্থান। একেই প্রাচীন মানুষ অরায়নের তলোয়ার বলত।

অরায়ন নেবুলা, যা M42 নামে পরিচিত
মহাবিশ্ব যেহেতু সর্বদাই সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাই কালপুরুষকে হয়ত কয়েক লক্ষবছর পর আর শিকারীর আকারে শনাক্ত করা যাবে না। তবে ধারনা করা হচ্ছে, ১২-১৩ লক্ষ বছর পরেও হয়ত কালপুরুষ এমনই আকাশে শিকারী রূপে থাকবে। তবে এর ডান কাধের তারা বেটেলজিউস একটি রেড জায়ান্ট। বড় তারাগুলো জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে এসে পড়লে রেড জায়ান্টে পরিণত হয়। যেহেতু বেটেলজিউস তার জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে, তাই কয়েকবছরের মধ্যেই হয়ত তারাটি সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়ে ব্ল্যকহোলে পরিণত হবে। অথবা হয়ত ইতোমধ্যেই ৬৪২ আলোকবর্ষ দূরে থাকা তারাটির মৃত্যু হয়েছে, আমরা জানতে পারব ৬৪২ বছর পরে!
Source:
- https://en.wikipedia.org/wiki/Orion_(constellation)
- http://www.constellation-guide.com/constellation-list/orion-constellation/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Orion_(mythology)
- https://en.wikipedia.org/wiki/88_modern_constellations
- https://en.wikipedia.org/wiki/Betelgeuse
– নামঃ তাহিয়া তাসনিম
-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ