লেখকের পরিচয়:
মোঃ রাফিউল ইসলাম
ফেইসবুক আইডি: facebook.com/Ralph.i.Infinity
দশম শ্রেণী – বিজ্ঞান শাখা
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ।
ইমেইল: islamrafiul046@gmail.com
জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আমাদের এতই ভ্রান্ত ধারণা যে, একে আমরা জ্যোতিষবিদ্যার সাথে গুলিয়ে ফেলি! “জ্যোতি” অংশটুকু শুনেই নাক কুচকে ফেলি, যদিও কেউ কেউ আবার এই জ্যোতিষীদের পেছনে ছুটি, খবরের কাগজের ভাগ্যফল পড়ি আর বলি, “নাহ, আজকে বোধহয় লটারির টিকিট কিনতেই হচ্ছে দেখছি!!”
দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে , Astronomy( জ্যোতির্বিদ্যা ) ও Astrology( জ্যোতিষবিদ্যা) একই সাথে একিভাবে গড়ে উঠতে থাকে। আদিকালে আলাদা আলাদা ভাবে এদের অস্তিত্ব ছিল না। অনেক বিখ্যাত লোকেরা, গণিতবিদেরা জ্যোতিষচর্চা করতেন তখন। তারা একই সাথে জ্যোতির্চচা ও জ্যোতিষচর্চা করতেন। কিন্তু এখন আমরা জানি, কোনটা অপবিজ্ঞান, আর কোনটা সত্যিকারের বিজ্ঞান!!!
জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজ আকাশ পর্যবেক্ষণ, তারা নিয়ে গবেষণা, কোনটা কত দূরে,কতটা উজ্জ্বল কোনটা, এদের ভর কেমন বা এদের আকার কতটুক, ব্ল্যাকহোল, গ্যালাক্সি, দূর আকাশের নেবুলা বা সুপারনোভা বা পালসার, গ্রহদের গতি ও তাদের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে জানা সহ আরো অনেক কিছু নিয়ে। আর জ্যোতিষবিদ্যার কাজ ভণ্ডামি করা, ভাগ্য গণনা করা, লাল-নীল পাথরের আংটি ব্যবহার করে শনি গ্রহ কে নাড়িয়ে দেয়া, রাহু ও কেতু নামক কাল্পনিক গ্রহের অনিষ্ট নিয়ে চিন্তা করে মাথাব্যাথা করা এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবখানেই কিছু “ঘাড় তেড়া” লোক থাকে। আকাশের এ “ঘাড় তেড়া” জিনিস গুলিই “মুভিং স্টার্স” বা প্ল্যানেটস!! Planets শব্দের প্রতিশব্দ Wanderer যা দ্বারা বোঝায় “যারা ঘুরে বেড়ায়”। একেকটি গ্রহ বছরের বিভিন্ন সময়ে একেকটি তারামন্ডল টপকিয়ে কোনটার গা ঘেঁষে, কোনটার ভেতর দিয়ে, কোনটার নাক এর উপর দিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে। ( তারামণ্ডল হল আদি সভ্যতা গুলোর তৈরী কিছু প্যাটার্ন যা আকাশের উজ্জ্বল তারাদের নিয়ে গঠিত) কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে আবার কখনো পশ্চিম থেকে পূর্বে যেতে থাকে গ্রহগুলি।
গ্রহদের এই রকম গতির কোন রুপ ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল না। ধন্যবাদটা কিন্তু গ্যালিলিও, কোপার্নকাস, কেপলার ও টাইকো ব্রাহের মত জ্যোতির্বিদদের প্রাপ্য। তাদের হাতেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরম্ভ হয় এবং তাদের নিরলস পরিশ্রম ও পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের মাধ্যমে গ্রহ গতির এ রহস্যের সমাধান আমরা এখন জানি।
এই “রহস্যময়” গতি সম্পন্ন জিনিস গুলো নিয়ে সেই মানুষরা একেক রকমের কাহিনী তৈরী করতে থাকে। কেউ হয়ে যায় নারীর প্রতীক, কেউ আবার হয়ে যায় দেবতা!! কেউ যেমন তার শত্রু কে চোখে চোখে রাখে ঠিক তেমনি “জ্যোতিষী”রাও এ গ্রহ গুলোকে দেখে রাখতে থাকে! তারা বলতে থাকে, ” বৃহষ্পতির গ্রাস থেকে সাবধান! শনি আপনার দিকে ধেয়ে আসছে! এর থেকে বাঁচতে পাচ্ছেন ‘তিন শ টাকার লাল-কালা-বেগুণি পাথর! ”
কিন্তু এরা আকাশের আপাত স্থির তারাদের নিয়ে কখনোই বলে না, ” উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধক (Sirius/α canis majoris) এর আলোয় আপনার জীবন আলোকিত হয়ে উঠবে, ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে উজ্জ্বল! কালপুরুষের কাধের তারা আদ্রা (Betelgause/α orion) এর শান্ত কমলা বর্ণের আলো আপনার জীবনে বয়ে আনবে অফুরন্ত সুখ-শান্তি!! সপ্তাহে দুবার রাতের আকাশ দেখুন আর আপনার জীবন হবে জলবৎ তরলং!!!”
আদি মানব প্রথম প্রথম মাথার উপরের এ বিশাল আকাশের বিষ্ময় গুলির দিকে তাকিয়েছে, কৌতুহলের কারণে সে এসব আলোকবিন্দুর রহস্য বের করার চেষ্টা করেছে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সূর্যের আপাত গতিপথ, চাঁদের গতিপথ ও এর কলা, অমাবস্যা/পূর্ণিমা,গ্রহণ, চলমান তারা বা গ্রহদের পর্যবেক্ষণ করেছে, সব কিছুর পেছনে ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টা করেছে। পরিবেশের যত বিপর্যয়, প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে আকাশকে মিলিয়েছে , যেগুলো তাকে আতঙ্কগ্রস্থ করেছে। আকাশের সাথে তার ভাগ্যের কাল্পনিক সম্পর্ক এভাবেই গড়ে উঠে এবং জ্যোতিষচর্চার শুরু হয়।
প্রাচীন জ্যোতির্বিদরাও জ্যোতিষচর্চায় আগ্রহ করেছিলেন যেমন হিপারকাস, টলেমি। আদিকালে জ্যোতিষচর্চা ছিল রাজাদের ব্যাপার। তারা রাজজ্যোতিষ থেকে গণনা করে জেনে কখন কার সাথে যুদ্ধ করতে হবে আর কখন কার সাথে বন্ধুত্ব! খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের দিকে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার রাজা আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। এভাবেই এ ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য জ্যোতিষবিদ্যার আমদানি ঘটে। জ্যোতিষচর্চা ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ে।
আমরা জানি, গ্রিক অ্যাস্ট্রোনমিতে আকাশের তারা গুলিকে ৮৮টি কন্সটালেশন বা তারামণ্ডলে বিভক্ত করা হয়েছে ,তো প্রতিটি তারামন্ডলের নিজস্ব এলাকা রয়েছে। সব তারামণ্ডলের এলাকা পাশাপাশি রেখে সমগ্র আকাশ-গোলকের মানচিত্র আমরা পেয়ে যাই। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তাই বছরের একেক সময়ে সূর্যকে একেক অবস্থান থেকে দেখা যায়। এই কারণে সূর্যের পেছনের আকাশ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। মনে হয় যেন সূর্য এক এলাকা ছেড়ে ধীরে ধীরে আরেক এলাকায় ঢুকতে থাকে। এক বছরে বা ১২ মাসে নির্দিষ্ট ১২ টি তারামণ্ডল এর এলাকা দিয়ে সূর্যকে যেতে দেখা যায়। এই ১২ টি এলাকাকেই বলা হয় রাশি। ক্রান্তিবৃত্তের মধ্যে ১২ রাশি, ২৭টি উজ্জ্বল নক্ষত্র আছে। জন্মের সময়ে চাঁদকে যে রাশিতে দেখা যযায় তাকে বলা হয় জাতকের রাশি।পূর্বদিগন্তে যে রাশি দেখা যায় তাকে বলা হয় লগ্ন।চাঁদের কাছাকাছি যে নক্ষত্র থাকে তাকে বলা হয় জাতকের নক্ষত্র।এভাবে জ্যোতির্বিদ্যার বিষয় আশয় এর উপর ভিত্তি করেই এ ভাওতাবাজি গড়ে উঠেছে।
জ্যোতিষীরা যে কতটা ভণ্ড আর তাদের জ্ঞান যে কতটা প্রাচীন তা তাদের কথা বার্তাতেই বোঝা যায়। তাদের মতে গ্রহ হলো ৯ টি- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহষ্পতি ,শনি, চাঁদ, সূর্য , রাহু ও কেতু। চাঁদ কে নাহয় তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম গ্রহ হিসেবে, কিন্তু জ্বলন্ত এই সূর্য কীভাবে গ্রহ হতে পারে? আর রাহু ও কেতুর তো কোন অস্তিত্বই নাই! পৃথিবীর কক্ষতল ও চাঁদ এর কক্ষতল সম্পূর্ণভাবে এক নয়। এরা একে অপরকে ৫ ডিগ্রি ব্যবধানে ছেদ করে। যে দুইটি ছেদবিন্দু পাওয়া যায়, এদেরকেই গ্রহ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন এই জ্যোতিষীরা! এরা সবাই নাকি পৃথিবীকে আবর্তন করতে থাকে!!
আমাদের কর্মফল আমাদের উপরই নির্ভর করে, আমাদের সাথে যা কিছু ভালোমন্দ তা সামগ্রিক ভাবে সমষ্টিগত দিক থেকে আমাদের কর্মকাণ্ডেরই ফলাফল। এর সাথে এত লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার দূরের অবলা নিষ্প্রাণ গ্রহদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? এদের কাজই হল আবর্তন করা, তাই একেক সময় একেক জায়গায় এদের দেখা যেতে পারে। কয়েক মূহুর্ত আগে পরে জন্মানোর কারণে কী কারো জীবন বৃথা হতে পারে!? অনেকে হয়ত বলবেন আমরা নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের দেহের জিনিসগুলিও একসময় নক্ষত্রে তৈরী হয়েছে, তাই এর প্রভাব অবশ্যি আছে। কিন্তু আমরা তো স্বাধীনচিন্তা ভাবনা, বিবেক বুদ্ধির ও ক্ষমতার অধিকারি, একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় আমরাই আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি, আমরাই আমাদের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করে তুলি, বা হয়ত দুঃখ টেনে আনি। এজন্য কেন আমরা গণনা করে এসব বের করবো? এর থেকে নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাওয়াই উত্তম!!
সামান্য একটা রঙ্গিন পাথর কিভাবে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে তুলবে, বাচিয়ে রাখবে যত অনিষ্ট সাধন থেকে? আসলে সব কিছু আমাদের মনের মধ্যেই প্রথিত, আমাদের মনের ভীতিই আমাদেরকে এসব করতে বাধ্য করে। আমরা নিজের অজান্তেই আসন্ন যত বিপদ আপদ দূরে ঠেলে রাখতে চেষ্টা করি,আসন্ন সৌভাগ্য সম্পর্কে আগাম বার্তা শুনে আমোদিত হই এবং এর জন্য অপেক্ষা করতে চেষ্টা করি। অথচ চেষ্টা করলেই এসব সম্ভব হত নিজের পক্ষেই!!
জ্যোতিষীরা হাজারো রকম ভবিষ্যত বাণী করেন। এর মধ্যে দু চারটা দৈবক্রমে মিলে গেলেই তাদেরকে মাথায় তুলে নাচি আমরা। ১০০ টার মধ্যে ১/২টা কথা মিলে যাওয়া নিশ্চয়ই আশ্চর্যবোধক নয়, আমরা বাকি ৯৮ টার কথা ভুলে যাই এবং ঐ একটা মিলে যাওয়ার খুশিতে থাকি এবং বাকি গুলোর মিলে যাওয়ার জন্য অবচেতনভাবে অপেক্ষা করতে থাকি!
বর্তমানে অলিতে- গলিতে জ্যোতিষদের উৎপাত অনেক বেড়ে গিয়েছে। আসুন আমরা এই ভণ্ডদের প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই।তাদের এই ভাওতাবাজির ফাঁদে পড়ছে অনেক নিরীহ মানুষ জন। এমনকি উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা তেও এটি অন্যতমম বিশাল সমস্যা। সেখানকার জনগণ তাদের আয়ের একটা বিরাট অংশ ব্যয় করেন শুধুমাত্র এই ভাগ্যগণকদের পেছনেই!! বিজ্ঞান সচেতনতাই পারে এই অপবিজ্ঞান হতে আমাদের বিশ্বাসকে নষ্ট করতে।
তাই বলে জ্যোতির্বিদ্যা, আকাশ পর্যবেক্ষণ কখনো থেমে থাকবে না! এটি সগৌরবে, বীরদর্পে তার আসনে আসীন থাকবে!! আমাদের মাথার উপরেই কত বিষ্ময়! যাদের আমরা কখনো চোখ তুলে একটি বার দেখি না। আবোল-তাবোল তারা বলে এদের দিকে তাকাই না, বোঝার চেষ্টা করি না এই মহাজগৎ কে! খালি চোখেই যে পাঁচটা গ্রহ দেখা যায় তাদের খোজ খবর রাখি না।
ব্যস্ত জীবনে একটু আনন্দ খুজে দিতে পারে রাতের আকাশ! জ্যোতির্বিদ্যা আমাদেরকে এই জগৎকে বুঝতে শিখায়, চিন্তা করতে শিখায়, চোখকে মুগ্ধ করে, কৌতুহলী করে তোলে ও অমায়িক আনন্দ প্রদান করে। এই সুন্দর সপ্তর্ষিমণ্ডল, এই সুন্দর শুকতারার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মত ক্ষমতা শুধু আমাদেরই আছে, এদেরকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখবে- এমন কোন বুদ্ধিমান সত্তা কে আমরা আজো খুজে পাইনি। তাই আমাদের সবার উচিত – আমাদের এই স্পেশিয়ালিটিকে কাজে লাগানো!! রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হওয়া!! হাতে Stellarium, star walk, star map এর মত কোন অ্যাপ নিয়ে নেমে পড়ুন জগৎ দেখার কাজে আর হারিয়ে যান তারাদের এই রাজ্যে!!!
তথ্যসূত্র : জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ পাঠ-সৌমেন সাহা