নিউট্রন তারকা বা পালসার, যাকে রহস্যের সিন্দুক বলে অভিহিত করলে হয়ত ভুল বলা হবে না। তবে এখন সেই রহস্য অনেকাংশেই উন্মোচিত হয়েছে বলা যেতেই পারে।
তারকা দিয়ে নাহয় শুরু হোক। তারকা হল প্লাজমা দশাস্থিত অতি উজ্জ্বল এবং সুবৃহৎ গোলাকার বস্তুপিন্ড। তারকাতে জ্বালানী উৎপন্ন হওয়ার মূলে রয়েছে আবার নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া। যখন তারকাটির জ্বালানী নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন তারকাটি পরিণত হয় মৃত তারকায়, সৃষ্টি হয় শ্বেত বামন বা নিউট্রন তারকা। যদিও কৃষ্ণ বিবরেরও সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে তা নিতান্তই কম।
নিউট্রন তারকা বর্তমানে জ্যোতিঃপদার্থবিদদের কাছে এক অতি আকর্ষণীয় বস্তু। আর এজন্য এ পর্যন্ত এসেছে প্রচুর তাত্ত্বিক গবেষণা। তবে সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে টমাস এবং ফার্মী একটি মডেল প্রস্তাব করেন। এরপরেও স্রোডিঞ্জার মডেল, নাম্ব-জোনা- লাস্পিউ মডেল ও চিরাল SU বা কোয়ার্ক গড় ক্ষেত্র মডেল-ও এসেছে, যার সবই তাত্ত্বিক।
পালসার এক অন্যতম নিউট্রন তারকা, যা অত্যন্ত চৌম্বক আবর্তিত। এটি সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে উচ্চ তীব্রতার তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নির্দিষ্ট দিকে বিকিরণ করে থাকে। তবে এই নিউট্রন তারকাকে পালসার হিসেবে নামকরণের পিছনেও রয়েছে কারণ। যেহেতু এই তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ পালস হিসেবে লাভ করা যায়, তাই এর নাম ‘পালসার’। ১৯৬৭ সালে পালসার আবিষ্কৃত হয় জোসেলিন বেল কর্ণেল ও অ্যম্বনি হিউইশ এই দুই বিজ্ঞানীর হাত ধরে। যদিও তখন তারকা একে পালসার না ভেবে এর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে পৃথিবী বহির্ভূত অন্য উন্নত সভ্যতার দ্বারা সৃষ্ট রেডিও তরঙ্গ বলে ভেবেছিলেন। তারকা আকাশের নির্দিষ্ট স্থান থেকে ১.৩৩ সেকেন্ডের ব্যবধানে পালস লক্ষ্য করেছিলেন। পরে আকাশের অন্য প্রান্তে একটি দ্বিতীয় তরঙ্গ সূত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের পৃথিবী বহির্ভূত সভ্যতার তত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়। তাদের আবিষ্কৃত পালসারকে পরবর্তীতে ‘সিপি-১৯১৯’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘সিপি-১৯১৯’ রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করলেও পরবর্তীতে অনেক পালসার পাওয়া যায়, যারা আলোক তরঙ্গ, এক্সরে, গামা রশ্মি বিকিরণ করে। পালসারের প্রথম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আসে অবশ্য থমাস পোল্ডের কাছ থেকে। এরপর ১৯৬৮ সালে ‘ক্র্যাব পালসার’ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই ব্যাখ্যা সর্বজনগৃহীত হয়। ‘ক্র্যাব পালসার’-এর পর্যায়কাল ছিল প্রায় ৩৩ মিলিসেকেন্ড। তবে এই পালসার আবিষ্কার নিয়ে যেনো বিতর্কের শেষ নেই। কেননা ফ্রাস্কো পাচিনি সর্বপ্রথম ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারকার কথা বলেন। তবুও হিউইশ ও বেল কার্নেলকেই আবিষ্কারক ধরা হয় পালসারের। তাই এ নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট মতবিরোধ। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম হয়েছিল নোবেল কমিটির হাত ধরেই। কেননা ১৯৭৪ সালে পালসার আবিষ্কারস্বরূপ নোবেল পুরস্কার দেয়া হলেও তা যায় শুধু হিউইশের হাতে; যদিও হিউইশ-এর ছাত্রী বেল কার্নেল-ও ছিলেন এ আবিষ্কারের নেপথ্যে।
পালসার মূলত সেসব তারকা হতে সৃষ্টি হয় যেগুলির কোর সাধারণত সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরেও বেঁচে থাকে। পালসারের সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, এর এক চামচ পদার্থের ভর প্রায় ৬০ কোটি টন! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটিই সত্যি। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেছেন যে, তারকার কোরে এতই উচ্চ চাপ হয় যে, ইলেকট্রন, প্রোটন নিজস্ব সত্ত্বা হারিয়ে নিউট্রনের মতো আচরণ করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় NASA পালসারের কোরে সুপারফ্লুইডের অস্তিত্বের প্রমাণ পায়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বলে, পালসার ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকবে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, চীনারা ১০৫৪ সালে পালসারের দেখা পেয়েছিল, আর তা লিপিবদ্ধ করে গেছে বলে ধারণা করা হয়। আবার অনেকে এক কথায় পালসারের ব্যাখ্যা শেষ করেছেন, সেই মহান বাক্য হল, “নিউট্রনে ঠাসা এক তারকা”
পালসারের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে এখনও অনেক অনেক রোমাঞ্চকর রহস্য, যা অবিরাম খুঁজে চলেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। হয়তো একদিন উন্মোচিত হবে সকল রহস্য, এই আশায় শেষ করছি আজকের মতো।
Source:
https://www.space.com/40743-lonely-neutron-star-beyond-milky-way.html