সাম্প্রতিক মহাকাশ অভিযানগুলো থেকে পাঠানো বিভিন্ন গ্রহের যে সব ছবি আমরা দেখতে পাই, তার কিছু-কিছু রঙিন আর কিছু বর্ণহীন। কিন্তু এই ছবিগুলো দেখে কি আসলেই বুঝা যায়, প্রতিটি গ্রহ প্রকৃতপক্ষে দেখতে কেমন?
প্রশ্নটির সংক্ষিপ্ত উত্তরটা হলো ‘সবসময় নয়’। কারণ কিছু-কিছু গ্রহ আসলেই দেখতে রঙিন। অন্যান্য গ্রহের পৃষ্ঠতল প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধূসর শিলা দ্বারা আবৃত। তার মানে আপনি যখন এমন কোন গ্রহের রঙিন ছবি দেখতে পাবেন, তখন মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হতে পারেন যে ছবিটিতে কোন না কোন ভাবে কারসাজি করা হয়েছে। মানুষের চোখে ছবিগুলো দৃষ্টিনন্দন করার জন্যই এই অতিরঞ্জিত কারসাজিগুলো করা হয়ে থাকে।
আমরা যারা ছবি তোলার জন্য মোবাইল ব্যবহার করি তারা হয়ত লক্ষ্য করে থাকব যে, ছবিগুলোর রং পরিবর্তন করার জন্য মোবাইলে নানান অপশন থাকে যাতে করে ত্রুটিপূর্ণ ছবিগুলোও দৃষ্টিনন্দন লাগে। মহাকাশযান থেকে পাঠানো ছবিগুলো প্রক্রিয়াকরণ করার জন্য এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
মহাকাশযানে থাকা ক্যামেরাগুলোর রং শনাক্ত করার কৌশল আর মানুষের চোখের রং শনাক্তকরণ কৌশলে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন লাল-সবুজ ও নীল রং আলাদাভাবে সংরক্ষিত হয় এবং তিনটি রঙের জন্য তিনটি আলাদা সাদা-কালো ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। এর পর প্রদর্শনের জন্য তিনটি রঙ-কে সংমিশ্রণ করে একটা রঙিন ছবির রূপ দেয়া হয়। কিন্তু এই একই দৃশ্য যদি মানুষ নিজের চোখে দেখত, তাহলে মহাকাশযান থেকে প্রাপ্ত ছবির সাথে তার উপলব্ধিকৃত ছবির মাঝে বেশ পার্থক্য দেখতে পেত। এর মানে এটা দাঁড়ায়, মহাকাশযান থেকে প্রেরিত কারসাজি না করা ছবিগুলোর রং বাস্তবিক রঙের সাথে যে মিলে যাবে এমনটা নয়। মহাকাশযানে থাকা ক্যামেরা যেকোনো আলোকরশ্মি সংরক্ষণ করতে পারলেও সেগুলোকে প্রকাশের জন্য লাল,সবুজ আর নীল রং-ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অতিবেগুনি, অবলোহিত রশ্মি প্রকাশের জন্যও এই তিনটি রং-কেই মিশ্রণ করে প্রদর্শন করা হয়। তার মানে প্রকাশিত ছবিগুলোর রং আসলে অবাস্তব। চলুন, গ্রহগুলোর কিছু উদাহরণ দেখে আসি।
দানব গ্রহ বৃহস্পতি
বৃহস্পতি গ্রহের একটি বিখ্যাত লাল স্পট রয়েছে যা মূলত দৈত্যাকার ডিম্বাকৃতি ঝড়ের ফসল। বায়ুমণ্ডলের নানান স্থর ভেদ করে দেখা হচ্ছে বলেই হয়তো রং-গুলোকে হালকা অস্বচ্ছ দেখায়। লাল স্পট সৃষ্টির জন্য কোন এক অজানা উপাদান দায়ী। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে সেখানে ফসফরাস, সালফার এবং জটিল জৈব যৌগের মিশ্রণ থাকতে পারে।

বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার প্রাকৃতিক লাল স্পট
বৃহস্পতি গ্রহের এ রূপ রঙিন হওয়ার প্রবণতা তার একটি বৃহৎ উপগ্রহ “আইও” এর মধ্যেও দেখা যায। বারংবার আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুত্পাতের ফলে উপগ্রহটির পৃষ্ঠে সালফার ও সালফার ডাইঅক্সাইড এর ঘন আস্তরণ জমে। ফলে উপগ্রহটিকে হলুদ পিজ্জার মত দেখায়! পিজ্জার মধ্যে বিক্ষিপ্ত কালো জলপাই এর মত বর্ণগুলো মূলত লাভা ছাড়া আর কিছুই না।

বামে “আইও” এর প্রাকৃতিক রং, ডানে “ইউরোপা” এর কারসাজিকৃত ছবি।
এর পরে আসে বৃহস্পতির আর একটি উপগ্রহ ‘ইউরোপা‘। ইউরোপার উপরিতল মূলত বরফের আস্তরণে তৈরি। এর ফলে ইউরোপার পৃষ্ঠতল দারুণভাবে প্রতিফলকের কাজ করলেও উপগ্রহটি তেমন একটা রঙিন নয়। আমরা সচরাচর ইউরোপার যে সব ছবি দেখতে পাই তা আসলে কারসাজিকৃত ছবি। কারসাজি করে রং পরিবর্তন করার একটা কারণ হলো, স্বচ্ছ বরফ (নীল) ও অস্বচ্ছ বরফ (লাল) এর মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শন করা।
শনি গ্রহ
বৃহস্পতি ও শনির বায়ুমণ্ডল প্রায় একই হওয়া সত্বেও শনি গ্রহের দৃশ্যমান রং কম। শনির প্রাকৃতিক রং হলো অনুজ্জ্বল হলুদ। এর কোনো রঙিন ছবি দেখলে বুঝতে হবে ছবিটি ভুয়া অথবা কারসাজিকৃত।

শনির একটি কারসাজিকৃত ছবি
ইউরেনাস ও নেপচুন
ইউরেনাস ও নেপচুন দুটি গ্রহই অত্যন্ত ঘন বায়ুমণ্ডল দ্বারা আবৃত। আমাদের চোখে ইউরেনাস সবুজ এবং নেপচুন নীল দেখাবে। কারণ, তাদের মেঘ ঘন মিথেন গ্যাস এর আস্তরণে তৈরি যা সূর্যের লাল আলোকে বাধা দিয়ে শুধু সবুজ ও নীল রং-কেই প্রদর্শন করে। গ্রহ দুটিতে রঙের তেমন বাহার দেখা যায় না। সর্বোচ্চ স্থরের মেঘ সাদা হলেও সর্বত্র সবুজ ও নীল রং দেখা যায়।

নেপচুন এর প্রাকৃতিক রং
পাথুরে গ্রহ মঙ্গল
মঙ্গল গ্রহকে পাথুরে গ্রহ বা লাল গ্রহ বলেও ডাকা হয়ে থাকে। শিলার লেগে থাকা আয়রনের আস্তরণ মরিচা বা আয়রন অক্সাইড-এ পরিণত হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করে। ফলে গ্রহটিকে লাল দেখায়, মঙ্গলের আকাশও লাল।

মঙ্গল পৃষ্টের একই ছবির তিনটি আলাদা সংকলন। বামে- প্রাকৃতিক, মধ্যে- মানুষের চোখে যেভাবে দেখাত, ডানে- পৃথিবীর আলোতে যেভাবে দেখাতো।
শুক্র গ্রহ
শুক্র গ্রহ সাদা মেঘে আবৃত। মেঘের ভিতর দিয়ে লালচে বর্ণের গ্রহটিকে কমলা রঙের দেখায়। শুক্র গ্রহের লাভাগুলো পাথরে পরিণত হয়ে ধূসর বর্ণ লাভ করে।

শুক্র গ্রহের মেঘের প্রাকৃতিক রং।

ভেনেরা-১৩ দিয়ে তোলা শুক্র এর পৃষ্ঠতল। উপরে প্রাকৃতিক,নিচে পৃথিবীর আলোতে যেভাবে দেখাত।
বুধ গ্রহ
বুধ হলো বায়ুহীন ধূসর শিলা আবৃত একটি গ্রহ। বুধের পৃষ্টে পতিত আলোক রশ্মির মাত্র ৭ শতাংশই প্রতিফলিত হয়। বুধ ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্বের তিন গুণ দূরত্বে পৃথিবী অবস্থিত। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে বুধ অনেক উজ্জ্বল গ্রহ।

বুধ গ্রহের ভুয়া রং দেখানো হয়েছে।
আজকে এই পর্যন্তই। এটা চিন্তা করার কোনো কারণ নেই যে ঘরের রং নিয়ে কারসাজি করাটা প্রতারণা! আমাদের চোখ ও মস্তিষ্ক যদি সেখানে বিবর্তিত হতো তাহলে হয়ত আমরাও ওরকম রং দেখতে পেতাম।
তথ্যসূত্র: https://theconversation.com/from-neptunes-blue-hue-to-jupiters-red-spot-are-the-colours-of-the-planets-real-62513