চিন্তা করুন তো, শতাব্দির সেরা মেধাবী মানুষটি স্বয়ং যখন একটি কাজকে অসম্ভব ভেবেছিলেন, আজ তা আমরা খুব সহজেই করতে পারছি!!বছরের পর বছর মানুষ তো বটেই, বিজ্ঞানিরাও যে ব্ল্যাক হোল এর অস্ত্বিত নিয়ে তর্কে মেতে উঠেছিলেন, তাদের মুখের উপর তালা মেরে আজ আমরা এমন কিছুই আবিস্কার করে বসেছি যে ছুটে এসেছে স্বয়ং ব্ল্যাক হোল থেকেই।অথছ ব্ল্যাক হোল থেকে আলোর মতো মহাজগতের সবচেয়ে দ্রুততম বস্তুটিও মুক্তি পেতে পারে না!!বুঝতেই পারছেন, আমরা আজ আমদের মহাবিশ্ব অন্বেষণের নতুন মাধ্যম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি।তবে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বুঝার আগে আমাদের কিছুটা বোঝা জরুরি যে আসলে গ্রাভিটি কি জিনিস।
বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য সহস্রাব্দির সেরা ট্র্যাজেডি নিউটনের মাথায় তরমুজ না পড়ে আপেল পড়া হলেও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মাথায় সেই তরমুজ ভেঙেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন।তিনি মহাকর্ষকে বল হিসেবে কল্পনা করার প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে সেখানে আবির্ভাব করেন স্থান-কাল বা স্পেস-টাইম নামক নতুন চতুর্মাত্রিক ধারণার।তার মতে মহাকর্ষ আসলে স্থান-কাল চাদরের বক্রতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

Curvature of the space-time due to the mass of the Earth. Credit: Business Insider
চলুন একটু সহজ করে নেয়া যাক ব্যাপারটা।ধরে নিচ্ছি আপনি চেয়ারের উপর বসে এই মুহূর্তে এই আর্টিকেলটি পড়ছেন।আপনি কেন ভেসে না গিয়ে চেয়ারের উপর বসে আছেন।আপনি বলতে পারেন, পৃথিবী তার মহাকর্ষ বলের জন্য আপনাকে টেনে ধরে রেখেছে যার নাম অভিকর্ষ বল।কিন্তু আইনস্টাইন এসে বললেন, মহাকর্ষ বলের দরুন টান বলতে কিছু নেই।তার মতে, পৃথিবী আপনার চারপাশের স্পেসকে বাঁকিয়ে ফেলেছে, তাই স্পেস নিজে আপনাকে চেপে বাধ্য করছে আপনার অবস্থানে থাকতে!!এথেকে আমরা বলতে পারি যে, এটি অনেকটা পানিতে আপনাকে ডুবিয়ে রাখলে আপনি যে চাপ(নিঃশ্বাস বন্ধের জন্য নয়!!পানির দেয়া চারপাশের চাপ।) অনুভব করবেন তার মতোই।
কি?মনে হচ্ছে নিউটনই তো ভালো ছিল?তবে চলুন দেখে নেই নিউটনের ধারণা কেন টিকতে পারলো না।আমরা সাধারণত ধারণা করে থাকি যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেননা সূর্য পৃথিবীকে মহাকর্ষ বলের দরুন টেনে রেখেছে।আবার আমরা জানি সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে সময় নেয় প্রায় ৮ মিনিট।এখন যদি হঠ্যাত করে যদি সূর্যকে উধাও করে দেয়া হয় তবে আমরা সে ঘটনা জানতে পারবো প্রায় ৮ মিনিট পরে।কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষের ধারণা মতে পৃথিবী তার আকর্ষণ বল হারাবে সাথে সাথেই।কিন্তু আমরা জানি যে, কোন কিছুই আলোর চেয়ে বেশী বেগে চলতে পারে না।তাই এখান থেকে আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের মহাকর্ষের প্রচলিত ধারায় বিশাল এক সমস্যা রয়েছে।তাই চলুন সকল শোক দলবল নির্বিশেষে জলাঞ্জলি দিয়ে আইনস্টাইন এর দেখানো পথে হাঁটা শুরু করি!!
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিশাল বস্তু যেমনঃ পৃথিবী, সূর্য কিংবা ব্ল্যাক হোল সবাই স্পেস-টাইমকে বাঁকাচ্ছে।আইনস্টাইনের মতে স্পেস-টাইমের এই বক্রতা সাধারণত ঘটে থাকে বস্তুর ভর ঘনত্বের জন্য।অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট আয়তনে যার ভর যত বেশী হবে, তার জন্য স্থান-কালের চাদরে বক্রতার পরিমাণটাও ততই বেশী হবে।এখন স্থান কালের চাদরে বস্তুর অবস্থানের যদি পরিবর্তন ঘটে তবে বক্রতার অবস্থানের ও পরিবর্তন ঘটবে।এখন সেই বস্তুটিকে যদি স্থান-কালের চাদরের মাঝে ঘোরানো হয়, কিংবা হঠাত উধাও করে দেয়া হয়, তবে আমরা স্থান-কালের চাদরে ঢেউ এর মতো দেখতে পারবো।ব্যাপারটা আরেকটু ঠাহর করা যাক।ধরুন, আপনি নদীতে কিংবা পুকুরে একটা ফুটবল পানিতে কিছুটা ডুবিয়ে রেখেছেন তাই সেখানকার পানিটা কিছুটা বেঁকে আছে।এবার আপনি যদি ফুটবলটিকে সেখান থেকে হঠ্যাত করে উঠিয়ে ফেলেন কিংবা ধরে পানিতে ঘুরান তবে আপনি তার চারপাশে ঢেউ দেখতে পারবেন।

Ripples in the space-time due to the movement of two black hole. Credit: Extreme tech
সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী স্থান-কালের চাদরের এই ঢেউই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কিংবা গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ হিসেবে পরিচিত।গ্রাভিটেশনাল ওয়েভের উৎপত্তি সাধারণত ঘটে থাকে যখন দুটি ব্ল্যাক হোল পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে একত্রিত হয়ে একটি বিশাল ব্ল্যাক হোলে রূপান্তরিত হয় কিংবা কোন বিশাল নক্ষত্রের বিস্ফোরণ কিংবা সংঘর্ষ ঘটলে।
২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমরা যে গ্রাভিটেশনাল ওয়েভটি শনাক্ত করেছিলাম তা ঘটেছিল দুটো ব্ল্যাক হোলের একত্রিত হওয়া থেকে।কম্পিউটার সিমুলেশলের মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি যে, সূর্য থেকে প্রায় ২৯ এবং ৩৬ গুণ বেশী ভরের দুটো ব্ল্যাক হোল একত্রিত হওয়ার পূর্বে ২১০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করেছিল।

Merging of the two black holes of different masses. Credit: Discovery Magazine Blog
তাদের মধ্যকার সংঘর্ষ এক বিস্ময়কর অদৃশ্য বিস্ফোরণ ঘটায়। চূড়ান্তরূপে আমরা যে ব্ল্যাক হোলটি পাই তার ভর ছিল সূর্য থেকে প্রায় ৬২ গুণ বেশী।কিন্তু মিলিত ব্ল্যাক হোলটির ভর হওয়ার কথা ছিল প্রায় ৬৫ গুণ বেশী।অর্থাৎ সূর্যের চেয়ে তিনগুণ বেশী ভর সংঘর্ষের মাধ্যমে উধাও হয়ে গিয়েছে!!এবার আসি আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র “শক্তি = ভর * (আলোর বেগ)^২”। এই সূত্র থেকে আমরা সহজেই জানতে পারি যে, ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে এবং তা বস্তুর ভরের সাথে আলোর বেগের বর্গ গুণ করলে আমরা যা পাই তার সমান। তাই আমরা সহজেই কল্পনা করতে পারি যে, তিন সৌরভর থেকে কি বিশাল পরিমান শক্তি স্থান-কালের চাদরে ছড়িয়ে পড়েছিল!! ঠিক এই কারণেই, প্রায় ১.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এই সংঘর্ষ ঘটে থাকলেও লাইগোর(LIGO-Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) বিজ্ঞানীরা এই সংঘর্ষের দরুন সৃষ্ট গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
বিশাল শক্তির দরুন গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করা সম্ভব হলেও তা এতো সহজ ছিল না।এটি অনেকটা আপনি ফুটবল দিয়ে যে ঢেউ পুকুরে তৈরি করেছিলেন, পানির উপর কোনভাবে বসে তা চোখ বুজে অনুভব করার মতো।আপনি নিশ্চিত যে ঢেউ আপনাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে তবে তা আপনার খুবই ক্ষীণ অনুভূতি সৃষ্টি করবে।গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ এর জন্য এই ক্ষীণতা মানুষ তো দূরের কথা, আমাদের সবচেয়ে সংবেদনশীল যন্ত্রগুলোর কাছেও ক্ষীণ।তাই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ যন্ত্র গুলোর যে পরিবর্তন ঘটায় তা হিসাব করাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ অর্থাৎ ঢেউটি যখন কোন বস্তুকে অতিক্রম করবে তখন বস্তুটির স্পেস-টাইমে কিছুটা বিকৃতি ঘটবে।আর তাই বস্তুটিও কিছুটা স্প্রিং এর মতো সংকুচিত এবং প্রসারিত হবে।আর যেহেতু বস্তুটি সংকোচিত এবং প্রসারিত হবে তাই বস্তুটির উপর থাকা দুটি বিন্দুর দূরত্বও বাড়বে এবং কমবে।এই তত্ত্বই লাইগো ব্যাবহার করেছিল গ্রাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে।তবে দুটি বিন্দুর মধ্যে এই দূরত্বের বাড়া কমা শনাক্ত করার জন্য খুবই ক্ষুদ্র।লাইগো ক্ষেত্রে এই বাড়া কমা ছিল প্রায় একটি প্রোটনের ব্যাসের দশ হাজার ভাগের একভাগ!!

Graph of the signal detected by the LIGO in 14 September, 2015. Credit: Quanta Magazine
আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেছিলেন এতো সংবেদনশীল যন্ত্র তৈরি করা হয়তোবা মানব জাতির জন্য অসম্ভব।কিন্তু আমাদের এই মানব জাতি প্রতিনিয়তই এমন অসম্ভবকে সম্ভব করে সামনে এগিয়ে চলছে।কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি যে, মানবজাতির একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে আপনি এটা নিয়ে পড়ে থাকবেন যে আইনস্টাইন ভুল করেছেন।একটু অনুভুতির বদল মাথা খাঁটিয়ে চিন্তা করুন আইনস্টাইন আসলে ঠিক কেন ভুলটা করেছিলেন।একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে আপনি এটা ভালো জানার কথা!!যদি খুঁজে না পান তবে আপনার বাঙ্গালিত্ব গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়ে অপেক্ষা করুন পরবর্তী পর্বের জন্য।সেখানে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে গত ১০০ বছরের এই বিশাল দৌড়ে বিজ্ঞানীরা বিজয়ের হাসি হাসলেন এবং আলফ্রেড নোবেলের এতোগুলো টাকা হাতিয়ে নিলেন!!তবে আপনার জন্য পরবর্তী পর্বটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিক অন্য কারণে।আর সেটা হলো আমি আপনার বাঙ্গালিত্ব ফিরিয়ে আনতে আইনস্টাইন এর ভুলের কারণটি আপনাকে বলে দেব!!
তথ্যসুত্রঃ
- Wikipedia
- Is god a magician by Michio Kaku
- The Elegant Universe by Brian Greene
- Space.com
- LIGO-Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory
- The Telegraph
- Sciencemag.org
2 comments
next part kobe kothay pabo?
http://openspace.org.bd/%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%81%E0%A6%9C%E0%A7%87-2/?preview_id=953&preview_nonce=260652d7e9&post_format=standard&_thumbnail_id=864&preview=true