রাতের আকাশের দিকে যখন তাকাই কত হাজার-হাজার নক্ষত্রই না আমরা দেখতে পাই। এসব নক্ষত্রের মনোরম আলোচ্ছটা রাতের আকাশের সৌন্দর্যকে হাজারগুণ বৃদ্ধি করে! অথচ তারকারাজির এ মহাসমুদ্রের কোন অস্তিত্বই একসময় এ মহাবিশ্বে ছিল না। তবে কবে সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম নক্ষত্র? ওই নক্ষত্রগুলো কি এখনকার মতই? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এতদিন ছিল একেবারেই অজানা। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে অবশেষে মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রের আবির্ভাব এবং প্রথম নক্ষত্রের আলো কেমন ছিল তা শনাক্ত করতে পেরেছেন! তারা সব পরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল ‘বিগ ব্যাং’ এর প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর পরে।

শিল্পীর চোখে মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র; source: N.R.Fuller, National Science Foundation
পরীক্ষা হতে প্রাপ্ত সংকেতটি ছিল এক ধরণের ফিঙ্গারপ্রিন্ট যা সৃষ্টি হয়েছে হাইড্রোজেন গ্যাস হতে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ দ্বারা। এগুলো কতিপয় প্রাচীন নক্ষত্র হতে শক্তি শোষণ করত। এই ফিংগারপ্রিন্ট দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, প্রথমদিকে মহাবিশ্বের চারপাশে যে গ্যাসীয় আবরণ ছিল তার তাপমাত্রা অনুমানকৃত তাপমাত্রা থেকে অনেক বেশীই ঠাণ্ডা ছিল। জ্যোতির্বিদগণ হিসাব করে দেখেন, এর তাপমাত্রা পরমশূণ্য তাপমাত্রা হতে মাত্র ৩ কেলভিন বেশী অর্থাৎ প্রায় -৪৫৪ ফারেনহাইট। কতিপয় পদার্থবিজ্ঞানী এক্ষেত্রে ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব আছে বলে ধারণা করেন। আর যদি তারা ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি প্রমাণ করতে পারেন, তবে প্রথমবারের মত মহাকর্ষীয় প্রভাব ছাড়াও অন্য কোথাও ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি প্রমাণ করা যাবে। এবং রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।
আরিজোয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় এর জ্যোতির্বিদ ‘জুড বাউম্যান’ বলেন, “এই প্রথমবারের মত বিগ ব্যাং ছাড়াও মহাবিশ্বের সূচনালগ্নের কোন সংকেত আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি।” নেদারল্যাণ্ডের গ্রনিনযেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজিস্ট ‘সালেম জারৌবি’ বলেন, “যদি এটি সত্যি হয় তবে অবশ্যই এটি আমাদের জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি। তবে আমাদের সাফল্য তখনই পূর্ণতা পাবে যখন অন্যান্য গবেষক দলও এ ব্যাপারে একমত হবেন। তবে এখন পর্যন্ত বলা যায় আমাদের অনুসন্ধানটি সঠিক।”
পদার্থবিদগণ মনে করেন প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে সংঘটিত বিগ ব্যাং মহাবিশ্বে একটি আয়নিক প্লাজমা অবস্থা সৃষ্টি করে, যা মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সাথে-সাথে ঠাণ্ডা হতে থাকে। প্রায় ৩,৭০,০০০ বছর পূর্বে এই আয়নিক অবস্থা হতে নিষ্ক্রিয় হাইড্রোজেন পরমাণু সৃষ্টি হয়। সময়ের সাথে-সাথে অভিকর্ষের প্রভাবে এগুলো পরষ্পরের সংস্পর্ষে আসে এবং সৃষ্টি হয় নক্ষত্র। মহাবিশ্বের এই পরিবর্তনশীল সময়কে বলা হয় কসমিক ডন (COSMIC DAWN)।
প্রথম দিকের নক্ষত্রগুলো হতে প্রতিনিয়ত অতিবেগুনি রশ্মি নির্গত হত। এর ফলে তাদের ফোটন কণার সাথে হাইড্রোজেন গ্যাসের সংমিশ্রণ ঘটে এবং এতে করে গ্যাসীয় স্তরটি অত্যন্ত স্বচ্ছ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে হাইড্রোজেন পরমাণু হতে রেডিও তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, যা একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে মহাবিশ্বে বিচরণশীল। এটিকে জ্যোতির্বিদগণ রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এছাড়াও জ্যোতির্বিদগণ বর্তমানের নক্ষত্রের সাথে মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নের নক্ষত্রের সাথে অনেক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমত বর্তমানের নক্ষত্রসমূহের সাথে প্রাচীন নক্ষত্রের গঠনগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। আধুনিক নক্ষত্রসমূহ প্রধাণত ৭০% হাইড্রোজেন, ২৮% হিলিয়াম এবং ১-২% অন্যান্য উপাদান(ধাতব পাদার্থ) নিয়ে গঠিত। অথচ প্রাচীন নক্ষত্রগুলো প্রধাণত ৭৫% হাইড্রোজেন এবং ২৫% হিলিয়াম ও ০% ধাতু নিয়ে গঠিত। প্রাচীন নক্ষত্র হতে আধুনিক নক্ষত্রের গঠনগত এই পার্থক্যের কারণ হচ্ছে নক্ষত্রের সৃষ্টিলগ্ন হতে প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়ামে পরিণত হয়, এবং হিলিয়াম হতে ভারী ধাতুর সৃষ্টি হয়। সেকারণে ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে নক্ষত্রের গঠন উপাদানে আরও বেশী পরিবর্তন আসবে, এবং একসময় দেখা যাবে নক্ষত্রে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এর চেয়ে ধাতুর পরিমাণ বেড়ে যাবে।

বিগব্যাং এর পর হতে বর্তমান পর্যন্ত সময় পরিক্রমা (ক)
শুরুর দিকের নক্ষত্র হতে প্রাপ্ত আলো এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ। ফলে সাধারণ কোন টেলিস্কোপ দিয়ে এই আলো শনাক্ত করাটা খুব কঠিন। তাই জ্যোতির্বিদগণ পরোক্ষভাবে এটি শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। সাধারণত নক্ষত্রগুলোর মাঝে খালি স্থানে হাইড্রোজেন গ্যাসে পূর্ণ থাকে। দীর্ঘ সময়ের কারণে আদি নক্ষত্রের আলো এসব হাইড্রোজেনের বৈশিষ্ট্যে অনেক পরিবর্তন সাধন করেছে। এই পরিবর্তনের কারণে হাইড্রোজেন গ্যাস কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউণ্ড হতে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ শোষণ করতে সমর্থ হয়, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ২১ সেন্টিমিটার।

বিগব্যাং এর পর হতে বর্তমান পর্যন্ত সময় পরিক্রমা (খ) Source: N.R.Fuller, National Science Foundation
এই তরঙ্গ সংকেত শনাক্ত করার জন্য গবেষক দল একটি রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন, যার নাম ‘এক্সপেরিমেন্ট টু ডিটেক্ট দ্যা গ্লোবাল ইপোক অফ রিআয়োনাইজেশন সিগনেচার’ সংক্ষেপে EPOCH, যা পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ার মারকিসন রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি মানমন্দিরে অবস্থিত। কিন্তু শীঘ্রই বাউম্যান ও সহকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করলেন যে শনাক্তকৃত সংকেতের তরঙ্গদৈর্ঘ্য তাদের হিসাবকৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ধারে কাছেও নেই। ফলাফলটিতে এত বৈপরিত্য দেখে গবেষকগণ আরও ২ বছর ব্যয় করলেন এটা দেখার জন্য যে, কোন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফলাফলটি ভুল এসেছে কিনা। এজন্য তারা আরও একটি অ্যান্টেনা তৈরি করেন এবং যন্ত্রটি বিভিন্ন সময়ে আকাশের বিভিন্ন স্থানে রেখে পরীক্ষা চালান। বাউম্যান বলেন, “দীর্ঘ ২ বছর বিভিন্ন পরীক্ষা চালানোর পর আমরা কোন যান্ত্রিক ত্রুটি খুঁজে পাইনি এবং অবশেষে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।” এমনকি এ থেকে তারা আরও একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে, মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের কারণে এই তরঙ্গ হতে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ হতে থাকে এবং তরঙ্গটির চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়। এটা থেকেই গবেষক দলটি প্রথম নক্ষত্র সৃষ্টির সময় নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, বরং আবিষ্কৃত তরঙ্গ সংকেতটির অদৃশ্যতা থেকে তারা মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রটির ধ্বংসের সময়কাল নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা আবিষ্কার করেন যখন প্রথম নক্ষত্রটি ধ্বংস হয় তখন তা থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী এক্স-রে নির্গত হয়, যার কারণে আশেপাশের গ্যাসের তাপমাত্রা আকষ্মিকভাবে বৃদ্ধি পায় ও ফলশ্রুতিতে তরঙ্গ সংকেতটি দূর্বল হয়ে পরে। তারা পরীক্ষা করে বের করেন যে এই সময়টি হল বিগ ব্যাং এর প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর পর।

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মানমন্দিরে অবস্থিত রেডিও টেলিস্কোপ; source: nature.com
আদিম এই নক্ষত্রগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নক্ষত্রের আশেপাশের অন্যান্য বস্তুতাদি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেমন আদিম নক্ষত্রগুলোর ভূমিকা রয়েছে, ঠিক তেমনি তাদের বিষ্ফোরণের কারনে সেখানে ভারী পদার্থসমূহের একটি স্তর তৈরি হয়; যা কার্বন, অক্সিজেন-এ জাতীয় গ্যাসীয় পদার্থ নিয়ে গঠিত। এখান থেকেই পরবর্তীতে অন্যান্য নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছে। বাউম্যান বলেন, “আমরা যদি সত্যিই আমাদের উৎস সম্পর্কে জানতে চাই তাহলে এই ধাপটি আমাদের খুব ভালোভাবে জানতে হবে।”
ইসরায়েলের টেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজিস্ট ‘রেনান বারকানা’ বলেন, “জ্যোতির্বিদগণ যখন সংকেতটি শনাক্ত করেছিলেন তখন তার কম্পাঙ্ক স্বাভাবিক হলেও এর শক্তি ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। সংকেতটির শক্তিমাত্রা হতে বোঝা যাচ্ছে যে, কসমিক ডনের সময় হয় তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের পরিমাণ হিসাবকৃত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশী ছিল, অথবা ঐ পরিবেশে গ্যাসীয় পদার্থসমূহ ধারণার চেয়ে অনেকবেশী ঠাণ্ডা ছিল। দুইটি বিষয়ই অনেক অপ্রত্যাশিত এবং আশ্চর্যজনক।” তবে বারকানা মনে করেন, গ্যাসীয় পদার্থসমূহ কোন কিছুর প্রভাবে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে, যা মূলত ডার্ক ম্যাটারের দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে এটিকে বারকানা ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তিনি মনে করেন এ ফলাফল পদার্থবিদদের সাহায্য করবে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে নতুন তথ্য উন্মোচন করতে। উদাহরণস্বরূপ, বছরের পর বছর ধরে ডার্ক ম্যাটারের উপর এত পরীক্ষা চালানোর পরেও কেন সরাসরিভাবে ডার্ক ম্যাটার পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় নি? আর যদি এটি সত্য হয় তবে জ্যোতির্বিদগণকেও নতুন কিছু পরীক্ষা করতে হবে।
আপাতত কসমিক ডন হতে প্রাপ্ত সংকেত শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য পরীক্ষাও করা হচ্ছে। বেশিরভাগ জ্যোতির্বিদগণ নক্ষত্র সৃষ্টির কিছু সময় পরের হাইড্রোজেন গ্যাসের বৈশিষ্ট্য ও গতিবিধি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে ‘হাইড্রোজেন ইপোক অফ রিআয়োনাইজেশন অ্যারে’, এই পরীক্ষাটি করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘কারো’ মরুভূমিতে। এই এক্সপেরিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাউম্যানের টিম কর্তৃক শনাক্তকৃত রেডিও সংকেতটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য পুনরায় পরীক্ষা করা। এছাড়াও LOFAR (low frequency array)-নামক একটি এক্সপেরিমেন্ট করা হচ্ছে। এই এক্সপেরিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মাহাকাশের বিভিন্ন স্থানে রেডিও সংকেতের উঠা-নামার প্রবণতা পরীক্ষা করা। আর এই শক্তিশালী সংকেত যদি ডার্ক ম্যাটারের কারণে সৃষ্টি হয় তবে এর একটা সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন অবশ্যই থাকবে, এমনটাই ধারণা করেন বাউম্যান। কিন্তু ফলাফল যাই হোক না কেন এটা ভেবেই তারা খুশি যে, মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নের এক বিরাট রহস্য তারা খানিকটা হলেও সমাধান করতে পেরেছেন।
মহাবিশ্বের এমনই অনেক রহস্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর আমরা যদি আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর চাই তবে আমাদের দৃষ্টিসীমাকে আরও প্রসারিত করতে হবে। হয়তোবা সেই দিনটি আর বেশি দূরে নেই যেদিন মহাবিশ্বের সব অজানা প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
http://www.astronomy.com/news/2018/03/fingerprinting-the-very-first-stars
https://www.nytimes.com/2018/02/28/science/stars-dark-energy.html
https://news.nationalgeographic.com/2018/02/first-stars-universe-big-bang-edges-space-science/