গণিত থেকে সাহিত্য কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবকয়টি শাখাই প্রাচীনকাল থেকে মুসলিমদের পদচারণায় সমৃদ্ধ হয়েছে। ধর্ম প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে সমান তালে অবদান রেখে গেছেন বিভিন্ন মুসলিম মনীষীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাতেও তার প্রভাব স্পষ্ট। সেই প্রথিতযশা জ্যোতির্বিদদের নিয়েই আজকের এ উপাখ্যান।
১। ওমর খৈয়াম
“যদি কোনোদিন ছন্দিত পায়ে আগন্তুকরা আসে,
তারা খচিত তৃনের আসনে, এই বাগিচার পাশে
ফুল্ল হৃদয়ে তুমিও সেখানে চরণ চিহ্ন এঁকো
একটি শূন্য সুধার পেয়ালা নিভৃতে উপুড় করে রেখো।” – ( ওমর খৈয়াম )
একজন পারস্য কবি ও গণিতজ্ঞ হিসেবেই ওমর খৈয়াম অধিক পরিচিত। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্যও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর পুরো নাম গিয়াস আল-দিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-নিশাপুরি আল-খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১)। তিনি ১০৪৮ সালের ১৮-ই মে খ্রীঃ ইরানের গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যিক শহর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা গ্রহনের জন্য যুবক বয়সেই তিনি সমরখন্দে (পূর্ব আজারবাইজানের মারাঘে শহর) চলে যান। সেখানে জ্ঞানার্জন শেষে বুখারায় ফিরে এসে একজন গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

ওমর খৈয়াম
১০৭৩ সালে সেলজুকের বাদশা মালিক শাহের আমন্ত্রনে তিনি ও আরও কয়েকজন জ্যোতির্বিদ মিলে একটি মানমন্দির তৈরি করেন। সেখানে আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো টেলিস্কোপ না থাকলেও (তখনও টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয় নি) অনেকটা নিখুঁতভাবে খালিচোখেই ধৈর্যের সাথে তাদের গবেষনা চালিয়ে যান।
পারসিক বর্ষপঞ্জিকার সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। তিনি অসামান্য দক্ষতার সাথে বছরের প্রকৃত দৈর্ঘ্য দশমিকের ছয় ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর হিসাব মতে এটি ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন । বর্তমানে আমরা যে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করি তাতে প্রতি ৩,৩০০ বছরে একদিন গোলমাল হয়ে থাকে। কিন্তু তার সংশোধিত ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি ৫,৫০০ বছরে মাত্র এক ঘণ্টার গড়মিল হয় যা অনেকটাই উপেক্ষনীয় । ১০৭৯ সালের ১৫ মার্চ সুলতান জালাল আল-দিন মালেক শাহ সালজুক তাঁর এই সংশোধিত বর্ষপঞ্জী চালু করেন। বর্ষপঞ্জিকার এমন নিখুঁত সংস্কারের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান মহলে আজও তিনি সমাদৃত।
২। ইবনে আল হাইসাম
পশ্চিমাদের কাছে তিনি আল হাজেন নামেই অধিক পরিচিত। মূল নাম আবু’ আলী আল-হাসান ইবনে আলী-হাসান ইবন আল হাইসাম। ৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে আরব বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, এবং দার্শনিক। ইবনে আল হাইসামের উল্লেখযোগ্য অবদান অপটিক্স বা আলোকবিদ্যার মূলনীতি, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, আবহাওয়াবিজ্ঞান, চাক্ষুষ বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক নীতি। তিনি সর্বপ্রথম ক্যামেরার মূলনীতি আবিষ্কার করেন, যার উপর ভর করে আজকের আধুনিক ক্যামেরা, স্যাটেলাইট ইত্যাদি কাজ করে থাকে।

ইবনে আল হাইসাম
আল হাজেনকে বলা হয় আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক। তিনিই প্রথম বলেন যে চোখ থেকে আলো বের হয়ে কোনো বস্তুর ওপর পড়লে আমরা বস্তুটিকে দেখি না, বরং কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে আসলেই কেবল আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই।
৩। কেরিম কেরিমভ
আজারবাইজান বংশদ্ভূত একজন রাশিয়ান স্পেস প্রকৌশলী হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিত। তার জন্ম ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪-ই নভেম্বর আজারবাইজানের বাকু নামক স্থানে। প্রকৌশল পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ছোটোবেলা থেকেই তার প্রকৌশল বিদ্যার প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। ১৯৪২ সালে “আজারবাইজান ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ইন্সটিটিউট” থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি “দিজারঝিনস্কি আরটিলারি একাডেমিতে” তাঁর শিক্ষাজীবন চালিয়ে যান। যেখানে তিনি মূলত একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন। মহাকাশ অনুসন্ধান বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনি পথিকৃত হয়ে আছেন। সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পৃথিবীর প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশ জান “ভস্টক-১”- এর একজন লিড আর্কিটেকচার হিসেবে তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (The salyut and mir series) ও তাঁর পূর্বপুরুষ কসমস-১৮৬ এবং কসমস-১৮৮ উৎক্ষেপনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে।

কেরিম কেরিমভ
১৯৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহনের পর তিনি “রাসিয়ান ফেডারেল স্পেস এজেন্সি”-র মহাকাশজান উৎক্ষেপন কেন্দ্রের একজন পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের ইতিহাস নিয়ে তিনি রচনা করেন “The way to space” নামক একটি বই । মহান এই প্রকৌশলি ২০০৩ সালের ২৯-এ মার্চ মস্কোতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
৪। ফারুক এল বাজ
একজন মিশরীয় আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানী। তিনি ১৯৩৮ সিলের ২-রা জানুয়ারি মিশরের মানসৌরে জন্মগ্রহন করেন। অ্যাপোলো-১১ এর চাঁদে অবতরণ ও স্থান নির্ধারনের জন্য তিনি গবেষনা করেন। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের একজন সুপারভাইজর হিসেবে ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি নাসার সাথে কাজ করেছেন। এই ছয় বছর তিনি “Landing Site Selection Committee of Apollo-11” -এর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি এ প্রোগ্রামের প্রধান “ভিজুয়াল অবজারভার” ও ফটোগ্রাফার হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। সেই সময় অ্যাপোলো-১১ এ মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি কর্মরত ছিলেন। একইভাবে অ্যাপোলো-১৫ এর রোভার মিশনেও তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন। অসাধারন একজন প্রশিক্ষক হিসেবে মহাকাশচারীদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।

ফারুক এল বাজ
অ্যাপোলো-১৫ এর কমান্ডো পাইলট আলফ্রেড ওয়ারডেন প্রথমবারের মতো চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁর সম্পর্কে বলেন,” মি. কিংয়ের( ফারুক এল বাজের ডাকনাম ছিল কিং) কাছ থেকে প্রশিক্ষন নেয়ার পর এখন আমার মনে হচ্ছে আমি এর আগেও এখানে এসেছিলাম!”
বর্তমানে ফারুক এল বাজ ম্যাসাচুসেটস্ এর বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত আছেন।
1 comment
Awesome… Go ahead bro