ডার্ক ম্যাটার এর বিজ্ঞান ভিত্তিক অর্থ হল গুপ্ত পদার্থ বা অদৃশ্য পদার্থ বা তমো পদার্থ। তবে তত্বীয় পর্যবেক্ষন মুলক ভিত্তিতে এর অস্তিত্ব প্রমানিত হয়েছে। যদিও এ নিয়েও বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। মহাবিশ্বের গঠন সংক্রান্ত এক গবেষনায় দেখা যায় মহাবিশ্বের প্রায় ০.০৩% ভারি বস্তু , ০.৩% নিউট্রন নক্ষত্র , ০.৫% মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম ৮% , ডার্ক ম্যাটার ২৫% আর ৭০% হল ডার্ক এনার্জি (মহাকাশ সম্প্রসারণ শক্তি)। অর্থাৎ মহাবিশ্বের নক্ষত্র এবং উপগ্রহ গুলো ৭০ শতাংশই ডার্ক ম্যাটার এবং ৩০ শতাংশ দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে ঘটিত।

Figure: Energy Distribution of the universe. Source: Chandra X-ray Observatory
এই রহস্য ময় অজানা প্রকৃতির ডার্ক ম্যাটার এর সনাক্ত করার একমাত্র উপায় ছিল মহাকর্ষীয় প্রভাব। কেননা এরা অন্য পদার্থের সাথে কেবল মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে ক্রিয়া করে বলে ধারনা করা হয়। এছাড়া এরা কোনোরূপ তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ নিশঃরন বা শোষন কোনটিই করে না । অর্থাৎ তড়িৎচুম্বক তরঙ্গরে সাথে কোনোরুপ মিথষ্ক্রিয়ায় ও অংশগ্রহন করে না। তবে ডার্ক ম্যাটার কিছুটা আলো হয়ে আমাদের চোখে এসে ধরা দিয়েছিল ছায়াপথ গুলোর প্রকৃত ভর এবং দৃশ্যমান ভরের গড়মিল হিসেবে।
বিজ্ঞানীরা ছায়াপথ এর ভর কয়েক ভাবে নির্ণয় করেন। যেমনঃ
১। ছায়াপথ এর কেন্দ্র ঘিরে তারাগুলোর আবর্তন বেগ অনুসারে ।
২। সরল মহাকর্ষীয় লেন্সিং ব্যবহার করে ।
৩। দৃশ্যমান বস্তুগুলোর ভর নির্ণয় করে।
বিজ্ঞানীরা প্রত্যেকটি দৃশ্যমান তারা ও গ্যাস পিন্ডের নিজস্ব ভর যোগ করে সমগ্র দৃশ্যমান বা উজ্জ্বল পদার্থের মোট যে ভর পাওয়া যায় তা ঘূর্ণন বেগ দ্বারা পরিমাপ কৃত ভরের চাইতে অনেক কম । অর্থাৎ ছায়াপথ এর তারা সমূহ কে তাদের ঘূর্ণন বেগে ধরে রাখতে হলে দৃশ্যমান ভরের চাইতে আরো ১০ থেকে ১০০ গুন ভর থাকা প্রয়োজন । তাহলে এই অদৃশ্য পদার্থ গুলো কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রথম গুপ্ত পদার্থের কথা উঠে আসে।

Figure: The distribution of dark matter (colored in blue) in six galaxy clusters, mapped from the visible-light images from the Hubble Space Telescope. (Source: NASA, ESA, STScI, and CXC) Credit: NASA, ESA, STScI, and CXC
ইয়ান ওর্ট সূর্যের প্রতিবেশী সবগুলো তারার ভর যোগ করে দেখতে পান তা গতিবেগ দ্বারা নির্ণয় কৃত প্রকৃত মহাকর্ষীয় ভরের চাইতে অনেক কম । ১৯৩৩ সালে গুইকি ছায়াপথের বিচ্ছুরন নির্ণয় করে দেখতে পান এত অধিক চাপ এত বেগ এর ছায়াপথ গুলোকে স্তবকের মাঝে ধরে রাখতে হলে সেখানে দৃশ্যমান ভরের চাইতে ১০ থেকে ১০০ গুন বেশি ভর থাকা প্রয়োজন । তিনি আবার মহাকর্ষীয় লেন্সিং এর মাধ্যমে ভর গণনা করে দখতে পান যে, দৃশ্যমান ভর ও প্রকৃত ভর এর মধ্যে বিশাল এক ফারাক রয়েছে । তাই তার মনে প্রশ্ন আসে ,নিশ্চয় আরও অতিরিক্ত ভর সুপ্ত অবস্থায় আছে। তাই তিনিই প্রথম ডার্ক ম্যাটার শব্দটি ব্যাবহার করেন । ডার্ক ম্যাটার এর পক্ষে আরও জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন ভেরা রুবিন এর পরীক্ষা । তিনি ঘূর্ণন লেখচিত্র অংকন করে দেখতে পান যে ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বেগের মান না কমে সর্বচ্চ মানই অপরিবর্তিত থাকে । কিন্তু মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে ঘুরা কোন বস্তুর বেগের সংজ্ঞা হতে আমরা জানি যে,
অর্থাৎ যত ব্যাস বাড়বে তত বেগ কমবে। যেহেতু ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে দৃশ্যমান বস্তু বেশি তাই ব্যাসার্ধ বাড়ার সাথে সাথে ভর না বাড়ার আরেকটা উপায় হচ্ছে অতিরিক্ত ভর বৃদ্ধি পাওয়া । কিন্তু ডপলার সরণ থেকে দেখা যায় স্তবকে সেই পরিমান ভর নেই। এটি স্তবকে কোন অদৃশ্য বস্তুর থাকার সম্ভবনা প্রকাশ করে যার ফলে ব্যাসার্ধের বৃদ্ধির সাথে সাথে বেগ অপরিবর্তিত থাকে। এছাড়াও সর্পিলাকার ছায়াপথ এর ক্ষেত্রে ছায়াপথ এ বেগের বিচ্ছুরণ এর মাধ্যমেও গুপ্ত পদার্থের উপস্থিতি কল্পনা করা যায় ।
আসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম দিকেই কৃষ্ণবস্তু গুলো গুচ্ছাকারে বা দলবদ্ধ ভাবে মহাবিশ্বে ছড়িএ পড়েছিল এবং দৃশ্যমান বস্তুগুলো(যেমনঃগ্যাস ও অন্যান্য পদার্থ ) ডার্ক ম্যাটার এর বিস্তৃতি অনুসরন করছিল । কৃষ্ণবস্তু যেহেতু দৃশ্যমান বস্তুগুলোকে তাদের মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত করে , সেহেতু মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় এই দুই প্রকার বস্তু একত্রিত হয়ে গ্যালাক্সি ও অন্য মহাজাগতিক বস্তুপিন্ডের জন্ম দেয় । তারপর ক্রম বিস্তৃত এ মহাবিশ্বের প্রায় সব বস্তুর গঠন প্রক্রিয়ারই অদৃশ্য ও গুচ্ছাকারে অবদান রেখেছে।
মহাবিশ্বের এ অদৃশ্য বস্তুর মানচিত্র তৈরীর প্রকল্পে হাবলস্পেস টেলিস্কপের সাহায্যে প্রায় ১০০০ ঘন্টা দীর্ঘ পর্যবেক্ষন এর পর বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণবস্তুর গঠন ও অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ন্যাচার এ প্রকাশিত এ গবেষনা পত্রের বর্ননায় দেখা যায় বিজ্ঞানিরা প্রায় ৬০০ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থানরত কৃষ্ণবস্তুর অবস্থান নির্ণয় করেছেন এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ব্যাবহার করে এর একটি মানচিত্রও তৈরী করা সম্ভব হয়েছে।

Figure: The positions of vast, invisible isles of dark matter in the sky, within which normal “bright” matter galaxies are embedded like glittering gems. Credit: NASA
ডার্ক ম্যাটার এর ত্রিমাত্রিক মানচিত্র জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানের এমন কিছু সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে যা মহাবিশ্ব সংক্রান্ত গবেষনা গুলোকে অনুপ্রানিত করে আর মহাবিশ্বের সীমা ছাড়িয়ে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করবে। ডার্কম্যাটারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল সৃষ্টিতত্ত্ববিদরা মনে করেন ডার্ক ম্যাটার এমন কিছু অতি আনবিক কণা যা বিজ্ঞানীরা এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি এবং এটি আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বর্তমানে কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটি অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র ।
অন্যদিকে সুপারস্ট্রিং গবেষকরা বলেন, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে অবস্থিত বহুমাত্রিক জগত আমাদের জগতকে প্রভাবিত করে । তাই মহাকর্ষ বলে অসামাঞ্জস্য ব্যাখ্যা করার জন্য গুপ্ত পদার্থের প্রয়োজন পড়বে না, বিশ্বতরঙ্গের একীভূত তত্ত্ব দিয়েই তা সম্ভব। M. তত্ত্ব বলে আমাদের অতি পরিচিত স্থানের ৩ টি মাত্রা ও কালের একটি মাত্রা শেষ কথা নয় ,মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত ১১ টি মাত্রা অস্তিত্ব অনুমান করা গেছে। বাকি ৭ টি মাত্রা আমাদের থেকে লুকিয়ে আছে এবং কেবল কোয়ান্টাম স্কেলেই তারা প্রভাব রাখতে পারে। যদি এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলোতে কণা বা শক্তি থাকে তাহলে সেইগুলো হয়ে উঠতে পারে গুপ্ত পদার্থের বিকল্প। তবে ব্ল্যাক হোল, কোয়াসার, স্ট্রিং থিওরি, বিগব্যাং ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কিছুটা স্পষ্ট ধারনা পেলেও ডার্ক ম্যাটার এর রহস্য এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে। তবে মনে করা হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার আবিষ্কারের সাথে সাথে জানা যাবে আরও অনেক অজানা জিনিস, প্রমান হবে আরো অনেক জটিল সমস্যা ।
টীকা ১ – মহাকর্ষীয় লেন্সিংঃ
অধিক ঘনত্বের ভারি বস্তু স্থান কালকে বাকিয়ে দিতে পারে ,যা আমরা সাধারন আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে জানতে পারি । সাধারন আপেক্ষিক তত্ত্ব আরেকটা কথা বলে তা হল মহাকর্ষীয় লেন্সিং । সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেঞ্চুরি থেকে আলো পৃথিবী তে পৌছানোর পথে সূর্যের প্রবল মহাকর্ষের প্রভাবে তা বক্র আকার ধারন করে অর্থাৎ সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেকে যায় । ফলে পৃথিবীতে অবস্থানরত একজন পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে নক্ষত্রটিকে কোন ভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত বলে মনে হয়।

Figure: An illustration of the gravitational lensing. Credit: astro.caltech
এখন যার ভর বেশি (যেমন সূর্য,ব্লাক হোল) সে আগত আলোকে বেশি বাকাবে । ফলে যখন কোন পর্যবেক্ষকের নিকট নক্ষত্রের অবস্থান বেশি পরিবর্তিত মনে হয় তখন ধরে নেওয়া হয় এখানে বিশাল ভরের কোন মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে , যদিও তা দেখা নাও যায় । এভাবে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি ও তার ভর ও পাওয়া যায়.
Ɵ=4GM/ rc^2
যেখানে Ɵ বেকে যাওয়ার পরিমান, M পুরোভূমির বস্তুর ভর এবং r পুরোভূমির বস্তু থেকে আলোকরশ্মির দূরত্ব ।
টীকা ২ – ভেরা রুবিন এর পরীক্ষাঃ
১৯৫৯ সালে লুইস ভোল্ডার্স দেখিয়েছিলেন যে ত্রিকোণ মণ্ডলে অবস্থিত এম৩৩ নামক সর্পিলাকার ছায়াপথের ঘূর্ণন কেপলারীয় গতিবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই গবেষণা অনুসরণ করে ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে ও ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে তরুণ মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন সে সময়কার সবচেয়ে উন্নত স্পেকট্রোগ্রাফ দিয়ে কিছু সর্পিলাকার ছায়াপথের ঘূর্ণন চক্র তৈরি করেন। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন ছায়াপথের ব্যাসার্ধ্যের সাপেক্ষে ঘূর্ণন বেগের পরিমাণ একটি লেখচিত্রে অঙ্কন করেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে, বেগের বক্ররেখাটি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে যেমন নিচের দিকে নেমে যাওয়ার কথা ছিল তেমন হচ্ছে না।

Figure: Rotation curve of spiral galaxy M 33. Credit: Forbes
তাই ১৯৭৫ সালে অ্যামেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে সর্পিলাকার ছায়াপথের অধিকাংশ তারার বেগ ধ্রুব থাকে। ১৯৭৮ সালে তার এই ফলাফল আরেকজন বিজ্ঞানী সত্য প্রমাণ করেন।অবশেষে ১৯৮০ সালে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী গবেষণাপত্রে রুবিন তার পরিপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ করেন। তার ফলাফলের অর্থ দাঁড়ায়, হয় নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সঠিক নয়, নয়তো ছায়াপথের মোট ভরের একটি বিশাল অংশ গুপ্ত অবস্থায় আছে। এভাবেই প্রোথিত হয় গুপ্ত পদার্থের শক্ত ভিত্তি। গুপ্ত পদার্থের উপস্থিতির পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ অংশে এই পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
টীকা ৩– ছায়াপথের ঘূর্ণন গ্রাফঃ
এমন একটি ঘূর্ণন লেখ পাশের চিত্রে দেখানো হয়েছে। সকল সর্পিলাকার ছায়াপথের ঘূর্ণন বক্রই এমন হয়। লেখ থেকে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের কক্ষীয় বেগ কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে বাড়তে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট বেগে পৌঁছুনোর পর আর পরিবর্তিত হয় না। এমনকি অনেক দূর পর্যন্তও সকল বস্তুকে একই বেগে আবর্তিত হতে দেখা যায়। ১৯৭০ সালেই কেন ফ্রিম্যান এমন ঘূর্ণন বক্র তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এটি সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।

Figure: Rotation curves of the Andromeda Galaxy. Credit: Physics.org
কারণ ছায়াপথের চাকতির উজ্জ্বলতা কেন্দ্র থেকে যত বাইরের দিকে যাওয়া যায় তত কমতে থাকে। অর্থাৎ অধিকাংশ তারা এবং সেহেতু দৃশ্যমান ভর কেন্দ্রের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে ঘনীভূত। ব্যাসার্ধ্যের সাথে সাথে পদার্থের পরিমাণ কমতে থাকে।
রেফারেন্সঃ
- Fundamental Physics by Halliday & Resnick
- https://en.wikipedia.org/wiki/Dark_matter
- মহাবিশ্বের উৎস সন্ধানে-শংকর মুখোপাধ্যায়
- ভবিষ্যতে যাওয়া যাবে, যাবে না পিছনে ফেরা-আসিফ
লেখকঃ
মোহাঃ আব্দুর রহমান মিশকাত
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ (২য় বর্ষ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়