গল্পটি ১৯১৯ সালের, যখন জার্মানিতে বসবাসরত একজন অজানা গণিতবিদ একটি অদ্ভুত ধারণা উত্থাপন করেন। তার মতে আমাদের মহাবিশ্ব শুধু তিনটি মাত্রা দিয়ে তৈরি নয় আরও অনেক মাত্রা থাকতে পারে। এই গণিতবিদ ‘Theodor kaluza’- মনে করেন, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখনও আমরা এদের সন্ধান করতে পারছি না।
প্রথমদিকে এই ধারণাটি তেমন সাঁড়া ফেলতে পারেনি। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রযুক্তি আরো উন্নত হওয়ার পর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, গত শতকের শেষের দিকে আমরা বুঝতে পারি যে এই postulate-টি পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
ফিরে যাই ১৯০৭ সালে। আইনস্টাইন সম্প্রতি আবিষ্কার করলেন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। এখন মাথা ঘামাচ্ছেন মহাকর্ষ নিয়ে। কিন্তু সেই সময় অনেক বৈজ্ঞানিক ভৃত্য ছিলেন যারা মনে করতেন যে এই মহাকর্ষের ধাঁধার অনেক আগেই সমাধান হয়ে গেছে। ১৬ শতাব্দীর শেষেরদিকে নিউটন আমাদের উপহার দেন মহাকর্ষ সূত্র। বিভিন্ন ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই সূত্র বেশ ভালোই উপকারে আসে। তবে এত সব ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর পরেও একটি প্রশ্নের উত্তর বাদ পড়ে যায়। আচ্ছা ভাবুন তো, ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে থেকেও সূর্য সম্পূর্ণ শূণ্য জায়গা থেকে কিভাবে আমাদের পৃথিবীকে আকর্ষণ করছে? কিভাবে পৃথিবীর বৃত্তাকার কক্ষপথ তৈরি করছে? অনেক ভেবে আইনস্টাইন যে ব্যাখ্যা দিলেন তাতে তিনি সাহায্য নিলেন (স্থান-কাল) space time fabric-এর।
তার মতে আমাদের মহাবিশ্বের সবকিছুই অবস্থান করে একটি টান-টান ফেব্রিক এর উপর। যেখানেই ভর আছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে গর্ত বা বক্রতা। Space time-ফেব্রিকের বক্রতার ফলে আশেপাশের কম ভরের বস্তু সেসব বেশি ভরের বস্তুর চারপাশে নির্ধারিত কক্ষপথে ঘুরপাক খায়। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করি আমরা এবং আমাদের করে চাঁদ। আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব খুবই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন সেকালের বিজ্ঞানীরা। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণও করা হয়।
আইনস্টাইন ব্যবহার করলেন চারটি মাত্রা। আর এই চারটি মাত্রা দিয়েই সমাধান করে ফেললেন মাধ্যাকর্ষণ এর আদি-অন্ত। এই ভেবে kaluza-মনে করলেন তিনি যদি আরও একটি মাত্রা বাড়িয়ে দেন তাহলে হয়তো তিনি (electromagnetic) তড়িৎ চুম্বকীয় বলের রহস্যও উদঘাটন করতে পারবেন! তাই চিন্তা করে তিনি অংক কষতে বসে গেলেন। একটি বাড়তি মাত্রা ব্যবহার করার ফলে তিনি আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণের সমীকরণ এর সাথে আরও একটি বাড়তি সমীকরণ পেলেন। এই সমীকরণটি পরে আমাদের সাহায্য করে তড়িৎচুম্বকীয় বল বুঝতে। তবে এখানেই যে প্রশ্নটা জাগে তা হলো, আইনস্টাইন না হয় স্পেস-টাইম বক্রতা দিয়ে মাধ্যাকর্ষণ বুঝিয়েছেন; কিন্তু তড়িৎ চুম্বকীয় বলের জন্য আরও যে এই বাড়তি মাত্রার বক্রতা কল্পনা করা হচ্ছে এই মাত্রার খোঁজ কোথায় পাওয়া যাবে?
kaluza-এই সমীকরণটি মিলাতে পেরেই ভাবলেন, তিনি বুঝি ‘grand unified theory’-পেয়ে গেছেন। কিন্তু এতে দুটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে।
১. যদি আরও অনেক মাত্রা থেকেই থাকে তাহলে সেগুলো আমাদের কাছে ধরা দেয় না কেন?
২. যদি আমরা বিভিন্ন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করি তাহলে সেখানেও কি এই মাত্রার অস্তিত্ব আবশ্যক?
এই ঘটনার কিছু বছর পরে প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেন বিজ্ঞানী ‘Oslar Klein’। ১৯২৬ সালে তিনি দুটি পস্টুলেট প্রস্তাব করেন। তার মতে মাত্র দুই প্রকার। যথা:
১. বড় (যেগুলোর দেখা পাওয়া সহজ)
২. ছোট এবং সংকুচিত
বড় মাত্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানের তিনটি মাত্রা এবং সময়ের একটি মাত্রা। অন্যদিকে ছোট ও সংকুচিত মাত্রাগুলোর খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও খুব বেশি ছোট হওয়ার কারণে আমাদের ইন্দ্রিয়তে ধরা দিচ্ছে না। একটি উদাহরণ দিয়ে এটা বুঝানো যাক। কল্পনা করুন একটি রশি ১০ মিটার দূরে টানটান করে টানানো আছে। তার উপর দিয়ে রশির পরিধি বরাবর চলাচল করছে কয়েকটি পিঁপড়া। তাহলে সেই ছোট পিঁপড়াগুলোই বুঝবে যে রশিটি ত্রিমাত্রিক; দৈর্ঘ্য আছে, ব্যাসও আছে। চিকন হলেও এটি সিলিন্ড্রিক্যাল। অন্যদিকে ১০ মিটার দূরে টানানোর রশিটির দিকে আমরা তাকালে এর ব্যাস কিছুই বুঝতে পারব না। আমাদের মনে হবে এটি কেবল ১ মাত্রার একটি সরলরেখা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই উদাহরণ বলার উদ্দেশ্য হল ক্ষুদ্র মাত্রাগুলো লুকিয়ে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করা। এমন কি হতে পারে না যে, অতিরিক্ত ক্ষুদ্র হওয়ার ফলে এই মাত্রাগুলো আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে? স্থান-কালের ভীষণ গভীরে লুকিয়ে আছে এই অতিরিক্ত ক্ষুদ্র মাত্রাগুলো, যা আমরা আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে সন্ধান করতে পারছি না?
আইনস্টাইন ও Kaluza-দু’জন মিলেই বাকি মাত্রাগুলোর সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা চেষ্টা করেন মাত্রাগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করা। এতে তারা অংক কষে ইলেকট্রনের সঠিক ভরের কাছাকাছিও কোন সংখ্যা পান না। ফলে অতিরিক্ত মাত্রার ধারণাটি হালকা হয়ে আসে, ঘটনাস্থলে ১৯৫০ সালে বিলীনের খাতায় নাম লেখায়।
প্রথম-প্রথম স্ট্রিং থিউরি অতিরিক্ত মাত্রার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে বলে মনে হয় না। তবে আরেকটু গভীরে বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটলে বুঝা যায় যে অতিরিক্ত এই মাত্রার ধারণাই হল string theory-এর শিকড়। স্ট্রিং থিউরি এর প্রধান কাজ হল এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া, ‘সে সব মৌলিক, অবিভাজ্য, অপরিহার্য উপাদান গুলো কী, যা আমাদের চারপাশ সৃষ্টি করছে?’
আমাদের চারপাশে আছে নানান বস্তু। সেসব তৈরি অণু দিয়ে। অণুর পর্যবেক্ষণ করলে পাওয়া যাবে ইলেকট্রন যা কেন্দ্রের নিউট্রনের চারদিকে ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে, সাথে আছে প্রোটন। আরো গভীরে গেলে আছে কোয়ার্ক। Conventional ধারণা এখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এরপরে বিরাজ করে string theory, কম্পনরত ক্ষুদ্র সুতার মতো যা আমরা স্ট্রিং নামে চিনি। এই স্ট্রিং-ই হল আমাদের সৃষ্টির সবচেয়ে অবিভাজ্য বস্তু। একেকটি string এর একেক কম্পাঙ্ক। এই কম্পাঙ্কের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করছে কি ধরনের কণা সৃষ্টি করেছে। যেমনঃ ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, বিকিরণ কণা, ফোটন ইত্যাদি। স্ট্রিং থিউরিকে এক অর্থে ‘grand unified’ তত্ত্বও বলা যায়, তবে এই তত্ত্ব সত্যি হলে আমাদের মহাবিশ্বে ৪ টি নয়, ৫ টি নয়, মোট ১১ টি মাত্রা রয়েছে; দশটি স্থানের মাত্রা ও একটি সময়। আর এই string-গুলোর মধ্যে রয়েছে খুবই সূক্ষ্ম বিজড়িত জ্যামিতি।
স্ট্রিং তত্ত্বের সত্যতা যাচাইয়ের একটি মাত্র উপায় হল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত CERN এর LHC (Large Hadron Collider)-এ দুটি গ্র্যাভিটন কণার মুখোমুখি সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করা। তারপর সংঘর্ষের আগে ও পরে শক্তি যদি সমান না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে কিছু শক্তি অন্য মাত্রায় বাঁধা পড়ে গেছে। আমরা স্ট্রিং থিউরি এর সম্বন্ধে আরও পরিষ্কার প্রমাণ পেতে পারি।
Source:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/String_theoryS
http://www.physics.org/article-questions.asp?id=47